আমার সন্তান কি ভাইরাল হবে?
‘মা, মাগো আমি রাজা হতে চাই না, মানুষ হতে চাই’। ইরানের এক চলচ্চিত্রে একজন মায়ের কাছে সন্তানের আকুতি ছিল এমন। সন্তানের শিক্ষার শুরুটা হয় পরিবার থেকে। আন্তরিকতা, শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা নাকি ঘৃণা, হিংসা, লোভ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে সন্তান সেটা শেখার, জানার এবং বোঝার হাতেখড়িটা হয় পরিবারের মা-বাবা এবং সদস্যদের কাছ থেকেই।
আশির দশকের শেষের দিক থেকে আমাদের অর্থনীতির বাঁকবদল হয়। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি ফুলে-ফেঁপে ওঠে। আমাদের পকেটে টাকা আসতে থাকে। বাহারি জামাকাপড় আর খাবারের মেন্যুতে নতুন নতুন পদ যোগ হতে থাকে। পেটের ক্ষুধা মেটানো আর সমস্যা থাকে না।
বিজ্ঞাপন
আমরা বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হই। পেটের ক্ষুধা মেটানোর দিকে নজর এত চলে যায় যে মনের ক্ষুধা মেটানোর ব্যাপারটা জরুরি মনে হয় না আমাদের আর। জীবন থেকে শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার উধাও হতে শুরু করে। সেই জায়গায় ঠাঁই নেয় জমি, প্লট, ফ্ল্যাট, দামি বাড়ি-গাড়ি, ফ্রিজ, মোবাইল এবং সংযুক্ত হয় এসি।
আমাদের মনে হয় শিক্ষককে শ্রদ্ধা করার থেকেও জরুরি হয়ে পড়ে দুর্নীতি করে অঢেল টাকা আয় করা মানুষটা। আমরা এই ধরনের মানুষদের সমীহ করা শুরু করি। ভয় পেতে থাকি। টাকা দিলেই সব সম্ভব এই বিশ্বাসটা আমাদের মধ্যে গেঁড়ে বসে।
বিজ্ঞাপন
অভিভাবকদের আচরণেও পরিবর্তন আসতে থাকে। আগে যে অভিভাবক সততা, ন্যায়-নিষ্ঠার ব্যাপারে আপস করতো না, সেইসব অভিভাবক পরিবর্তিত হতে থাকেন। তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তারা ছেলে-বুড়ো সবাইকে নিয়ে বড় হতে চায়।
আমরা বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হই। পেটের ক্ষুধা মেটানোর দিকে নজর এত চলে যায় যে মনের ক্ষুধা মেটানোর ব্যাপারটা জরুরি মনে হয় না আমাদের আর। জীবন থেকে শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার উধাও হতে শুরু করে।
অভিভাবকরা সন্তানদের মানুষ হওয়ার বদলে অর্থ আয়ের পথে ধাবিত করতে থাকে। এটা কেউ করে জ্ঞানত কেউ অজ্ঞানত। পড়াশোনার চেয়েও অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার লোভ সন্তানদের মধ্যে ধাবিত হতে থাকে।
ডাক্তার হয়ে সেবা করার থেকে তখন গুরুত্বপূর্ণ হয় টাকা আয় করাটা। উকিল হয়ে সমস্যা সমাধান করার থেকে জরুরি হয় মানুষকে বিপদে ফেলে টাকা আয় করাটা। সন্তান লালনপালন করে মানুষ করার থেকে জরুরি হয় বিলাসী আইটেমে ঘর ভর্তি করে ফেলাটা। এই জার্নিতে যুক্ত হয় সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোমাধ্যম।
আরও পড়ুন
যে মানুষকে সবাই চেনে তার সামনে খুলে যায় অপার সম্ভাবনা এই ভাবনা থেকে আমরা মানুষের কাছে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করি। সেলিব্রেটি হওয়ার জন্য লড়াই শুরু করি। আর এই লড়াইয়ের প্রক্রিয়াটায় ইতিবাচক কোনোকিছু আমরা বেছে নিই না।
একসময় বাসায় অতিথি এলে ঘরের যে ছেলে বা মেয়েটা ভালো গান গায়, ছবি আঁকে তাকে ডাকা হতো গান শোনানোর জন্য, আঁকা ছবিটা দেখিয়ে বাহবা কুড়ানোর জন্য। ভালো কিছু ছড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস যখন আমরা হারালাম তখনই নেগেটিভ নিউজে ভরে গেল চারপাশ।
অভিভাবকদের মনে হলো পড়ুয়া, ভালো কাজ করা, ভালো গান করা ছেলেটা বা মেয়েটার আমাদের আর প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার ভাইরাল কিড। ভাইরাল কিডকে সবাই চেনে, ব্র্যান্ডগুলো ভিড় করে তার পণ্য প্রচারের জন্য, এমন সন্তানই তো আমরা চাই।
যে জায়গায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সন্তানরা শিল্পী, খেলোয়াড় বা অন্যান্য কার্যকলাপে নিজেদের যুক্ত করতে চায়, সেই জায়গায় আমাদের সন্তানরা এখন ভাইরাল হতে চায়। তাদের এবং পরিবারের মুখ্য উদ্দেশ্য যেন ভাইরাল হওয়া।
ভালো গান গাইতে হবে না, অপদার্থের মতো হেঁড়ে গলায় গাইলেই হিট। ভালো কিছুর মূল্য আমরা এখন আর দেই না, খারাপ কিছু করলেই শেয়ার বাটনে ক্লিক করি। আর শেয়ারের জন্য, ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ভাইরাল হোক আমার সন্তান এটা চাই কিন্তু মানুষ হোক তা চাই না।
কলিজা কেঁপে ওঠে একটা প্রজন্মের শেষ হয়ে যাওয়া দেখতে পেয়ে। যার পড়ার টেবিলে থাকার কথা ছিল, অভিভাবক তাকে রাস্তায় পাঠায় ভাইরাল হওয়ার জন্য বা অভিভাবকদের এড়িয়ে সে নিজেই চলে আসে ভাইরাল হওয়ার নেশায়।
'মাগো, অত আদর, অত স্নেহ সব করিলি মাটি/কঠিন করে করলে শাসন হতাম আমি খাঁটি'—এই কথায় শুধু টের পাই সন্তান লালন পালনের জার্নিতে আদরের সাথে সাথে শাসনটাও জরুরি। সন্ধ্যার সাথে সাথে খেলার মাঠ থেকে ফিরে পড়তে না বসলে কড়া শাসন আর বকুনি ছিল কপালে। আমাদের বলা হতো, 'পড়াশোনা করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।' আর এখন বলা হয়, 'ভাইরাল হয় যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।' সেইসব দিন কই? এমন মা-বাবা কই?
যে জায়গায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সন্তানরা শিল্পী, খেলোয়াড় বা অন্যান্য কার্যকলাপে নিজেদের যুক্ত করতে চায়, সেই জায়গায় আমাদের সন্তানরা এখন ভাইরাল হতে চায়। তাদের এবং পরিবারের মুখ্য উদ্দেশ্য যেন ভাইরাল হওয়া।
ক্যামব্রিজ, এমআইটি-তে পড়ে উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজে এগিয়ে যাওয়া, কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে মোবাইল হাতে নিয়ে আজব কাজকারবার করে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত আমাদের সন্তানেরা।
বিভিন্ন ব্র্যান্ড ভিউয়ে বাড়ানোর লোভে আরও ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের। ভিউ না বাড়িয়ে একটু ভালো কিছুর চর্চা করা দরকার। আসুন, ভালো আলো ছড়িয়ে দেই। আমি চাই না সন্তানরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠুক, ভাইরাল হোক। রাজা হওয়ার আগে, সবার আগে মানুষ হোক।
কিঙ্কর আহসান : কথাসাহিত্যিক