আধুনিক যুগে ডিজিটাল বিশ্ব আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আজকের শিশুদের বড় হয়ে ওঠা ঘটছে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পরিবেশে। মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্ট টিভি, সবই এখন তাদের শেখার, খেলাধুলার ও যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু এই সহজলভ্য প্রযুক্তি যতটা সুবিধা এনে দিয়েছে, ততটাই বাড়িয়ে দিয়েছে ঝুঁকি, পাশাপাশি বেড়েছে নতুন এক ভয় আর তা হলো সাইবার ঝুঁকি।

শিশুদের জন্য অনুপযুক্ত কনটেন্ট, গেম আসক্তি, সাইবার বুলিং, ফিশিং বা প্রতারণা, এসব বিপদ এখন হাতের মুঠোয়। এই বাস্তবতায় ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলস’ এখন অভিভাবকদের অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলস হলো এমন সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন, যা দ্বারা অভিভাবক তাদের সন্তানদের অনলাইন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এর মাধ্যমে কোন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যাবে, কতক্ষণ ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করা যাবে, এমনকি কোন অ্যাপ ডাউনলোড করা যাবে, সবকিছু অভিভাবক নির্ধারণ করতে পারেন। অনেক টুল আবার সন্তানের অবস্থান (location tracking) দেখায় এবং অনুপযুক্ত কনটেন্ট শনাক্ত করে ব্লক করে দেয়। অর্থাৎ এটি এক ধরনের ডিজিটাল অভিভাবক, যা সন্তানের অনলাইন জগতে সুরক্ষার বলয় তৈরি করে।

ইন্টারনেটের উন্মুক্ত দুনিয়ায় শিশুদের কৌতূহল যেমন প্রাকৃতিক, তেমনি বিপদের সম্ভাবনাও প্রবল। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের গবেষণা বলছে, অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহারে শিশুদের যে সমস্যা হতে পারে তা হলো মনোযোগ বিভ্রাট ও পড়াশোনার ক্ষতি, ঘুম ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সমস্যা এবং অনলাইন প্রতারণা বা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়ার আশঙ্কা।

তাছাড়া পর্নোগ্রাফি, সহিংস ভিডিও, ভুল তথ্য বা মাদক-সংক্রান্ত কনটেন্ট তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক সময় শিশুরা নিজেরাই বুঝতে পারে না কোন ওয়েবসাইট বা অনলাইন বন্ধুই নিরাপদ নয়। তাই অভিভাবকীয় নজরদারি ছাড়া তাদের ইন্টারনেট ব্যবহার প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলস এই ঝুঁকিগুলো কমিয়ে আনে এবং একটি সুরক্ষিত ডিজিটাল পরিসর তৈরি করে।

শুধু প্রযুক্তি দিয়ে শিশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলস কার্যকর হবে তখনই, যখন তা ব্যবহার করা হবে ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার সঙ্গে। অভিভাবকদের উচিত সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা...

বর্তমানে বাজারে নানা ধরনের টুলস পাওয়া যায়, যেগুলো অভিভাবকদের প্রয়োজন অনুযায়ী বেছে নেওয়া যায়। প্রথমটি হলো ‘Google Family Link’। অ্যান্ড্রয়েড ও ক্রোমবুক ব্যবহারকারীদের জন্য জনপ্রিয় এই টুলটি শিশুর অ্যাপ ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ, ওয়েব কনটেন্ট ফিল্টার ও লোকেশন ট্র্যাক করার সুযোগ দেয়।

দ্বিতীয়টি হলো ‘Microsoft Family Safety’। এটি উইন্ডোজ ও এক্সবক্স ব্যবহারকারীদের জন্য আদর্শ। এটি ব্রাউজিং নিয়ন্ত্রণ, সময় নির্ধারণ এবং লোকেশন শেয়ারিং সুবিধা দেয়।

তৃতীয়টি হলো ‘Qustodio’। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যাপ যা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, কল-মেসেজ মনিটরিং এবং অনুপযুক্ত ওয়েবসাইট ব্লক করতে সক্ষম।

চতুর্থটি হলো ‘Norton Family’। এটি নিরাপত্তা কোম্পানি নরটনের তৈরি এই টুলটি অনুপযুক্ত ভিডিও, গেম এবং ওয়েবসাইট ব্লক করে শিশুর মনোযোগ পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে।

শেষটা হলো ‘Kaspersky Safe Kids’। এটি শিশুদের অনলাইন কার্যক্রম ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ ছাড়াও ডিভাইস ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

এই টুলগুলো সাধারণত শিশুর ডিভাইসে ইন্সটল করা হয় এবং অভিভাবক তাদের নিজস্ব ডিভাইস থেকে অ্যাক্সেস পান। টুলটি ওয়েবসাইট ও অ্যাপ শ্রেণিবদ্ধ করে দেখে কোনটি শিশুর জন্য অনুপযুক্ত। এমন কনটেন্ট শনাক্ত হলে সেটি ব্লক করে দেয়। কিছু উন্নত টুল আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে, যা শিশুর সার্চ বা ব্রাউজিং প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করে সতর্কবার্তা পাঠায়।

অভিভাবকরা তাদের নিজের ডিভাইসে একটি ‘প্যারেন্ট অ্যাপ’ ব্যবহার করে সন্তানের ডিভাইসে ইন্সটল করা ‘চাইল্ড অ্যাপ’-এর মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ফলে এটি হয়ে ওঠে একপ্রকার ডিজিটাল অভিভাবকত্বের ভার্চুয়াল হাতিয়ার। এই টুলসগুলো শুধু ফিল্টারিং নয় বরং রিয়েল-টাইম মনিটরিংও করে।

যেমন স্পাইরিক্স (Spyrix) প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অ্যাপ সন্তানের সোশ্যাল মিডিয়া কার্যকলাপ ট্র্যাক করে এবং সন্দেহজনক আচরণের সতর্কতা পাঠায়। একইভাবে, ক্রোহা (Kroha) অ্যাপ স্ক্রিন ক্যাপচার ফিচারের মাধ্যমে সন্তানের ডিভাইসের রিয়েল-টাইম ছবি নিয়ে অভিভাবকদের আপডেট রাখে।

তবে এই টুলগুলোর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ শিশুদের মধ্যে গোপনীয়তা হারানোর ভয় তৈরি করতে পারে।

অনেক সময় তারা মনে করতে পারে, অভিভাবক তাদের বিশ্বাস করেন না। তবে শুধু সফটওয়্যার ইন্সটল করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। সন্তান যেন মনে না করে তার সাথে গুপ্তচরবৃত্তি করা হচ্ছে, এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বরং তাকে বোঝাতে হবে যে এই ব্যবস্থা তার নিরাপত্তার জন্যই নেওয়া হয়েছে।

 

আবার প্রযুক্তি-সচেতন কিশোররা সহজেই এই সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতা বুঝে তা পাস কাটিয়ে ফেলতে পারে। ফলে কেবল সফটওয়্যারের ওপর নির্ভর না করে, সন্তানকে ডিজিটাল আচরণে সচেতনতা তৈরি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি তখনই কার্যকর হয়, যখন সেটির সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক যুক্ত থাকে।

শুধু প্রযুক্তি দিয়ে শিশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলস কার্যকর হবে তখনই, যখন তা ব্যবহার করা হবে ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার সঙ্গে। অভিভাবকদের উচিত সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা, যেমন কেন কিছু ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ, অনলাইন ঝুঁকি (যেমন ভুয়া খবর, অপরিচিত বন্ধুত্ব বা ক্ষতিকর চ্যালেঞ্জ) সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া, স্ক্রিন টাইমের পাশাপাশি আউটডোর খেলা ও বইপড়ার অভ্যাসে উৎসাহিত করা এবং নিজেও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সংযমী ও দায়িত্বশীল থাকা, যেন সন্তান সেটি অনুসরণ করে। যখন শিশুরা বুঝতে পারে যে এই নিয়ন্ত্রণ ভালোবাসার অংশ, তখন তারা প্রযুক্তির প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে।

বাংলাদেশে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের ব্যবহার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। অধিকাংশ অভিভাবকই জানেন না কীভাবে এসব টুল ইন্সটল বা ব্যবহার করতে হয়। আবার অনেকেই সন্তানের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কায় ব্যবহার করতে চান না। তবে বাস্তবতা হলো,প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলস কোনো ‘নজরদারি ব্যবস্থা’ নয়, বরং একধরনের সুরক্ষার ছাতা।

বিটিআরসি’র সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটিরও বেশি, যার একটি বড় অংশই কিশোর ও শিশু। বিটিআরসি ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করেছে, কিন্তু পরিবার পর্যায়ে ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এখনো বড় বাধা।

অভিভাবকদের মধ্যে এই সচেতনতা তৈরি করতে হবে যে, সন্তানকে ভালোবাসা মানে কেবল খাওয়ানো বা পড়াশোনা দেখাশোনা নয়, বরং তার অনলাইন জগতকেও নিরাপদ রাখা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের উচিত এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। সরকারি পর্যায়ে শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্পেইন চালু করাও সময়ের দাবি।

অভিভাবকত্ব আজ শুধু হাতে হাত রেখে নয় বরং স্ক্রিনের ওপার থেকেও সন্তানের পাশে দাঁড়ানোর নাম। তাই প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলসকে বলা যায় সন্তানের অনলাইন নিরাপত্তার এক আধুনিক, নীরব, কিন্তু শক্তিশালী ডিজিটাল অভিভাবক।

উন্নত দেশগুলো ইতিমধ্যে শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানকে ধরা যাক। দেশটির ‘ইন্টারনেট ইউজ সেফটি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে শিশুদের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলো বাধ্যতামূলকভাবে ফিল্টার সেবা দেয়।

অস্ট্রেলিয়াতে সরকার পরিচালিত eSafety Commissioner শিশুদের অনলাইন ক্ষতি রোধে দ্রুত অভিযোগ গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে COPPA (Children’s Online Privacy Protection Act) অনুযায়ী ১৩ বছরের নিচে শিশুর অনলাইন তথ্য সংগ্রহে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

এই উদাহরণগুলো থেকে বাংলাদেশও শিক্ষা নিতে পারে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে ‘Safe Digital Bangladesh for Children’ নামে একটি জাতীয় উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, ডিজিটাল যুগে সন্তানকে সুরক্ষিত রাখা মানে শুধু রাস্তায় বা স্কুলে নয়, তার স্মার্টফোনের ভেতরেও নিরাপত্তার প্রাচীর গড়ে তোলা। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলস সেই প্রাচীরেরই প্রযুক্তিগত নাম। এটি শুধু একটি সফটওয়্যার নয় বরং একজন সচেতন অভিভাবকের সহযাত্রী, যিনি চান তার সন্তান শিখুক, বেড়ে উঠুক এবং একইসঙ্গে নিরাপদ থাকুক।

অভিভাবকত্ব আজ শুধু হাতে হাত রেখে নয় বরং স্ক্রিনের ওপার থেকেও সন্তানের পাশে দাঁড়ানোর নাম। তাই প্যারেন্টাল কন্ট্রোল টুলসকে বলা যায় সন্তানের অনলাইন নিরাপত্তার এক আধুনিক, নীরব, কিন্তু শক্তিশালী ডিজিটাল অভিভাবক। প্রযুক্তি কখনোই অভিভাবকের বিকল্প নয়, তবে এটি হতে পারে তার সবচেয়ে কার্যকর সহচর একজন ডিজিটাল অভিভাবক, যে সন্তানের প্রতিটি অনলাইন পদক্ষেপে সুরক্ষার ছায়া বিস্তার করে রাখে।

ড. মো. আশরাফুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়