FIFA World Cup 2026
আমোদে আর্জেন্টিনা, বিপদে ব্রাজিল!
ফুটবল সম্রাট পেলে তিন তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছিলেন ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে। ওই বিশ্বকাপগুলোয় ১৬টি করে দল খেলেছিল! অর্থাৎ এখনকার নিরিখে প্রতিপক্ষ সংখ্যায় ছিল কম, শক্তিশালী দলের সংখ্যাও ছিল কম। অথচ সেই সময়ে বসেও পেলে বুঝেছিলেন— ‘The more difficult the victory, the greater the happiness in winning’ অর্থাৎ ‘জয় যত কঠিন হয়, জেতার আনন্দ তত বেশি হয়’।
তো ৪৮ দলের বিশ্বকাপে যে দল জিতবে সেই দেশটির আনন্দ কতখানি হবে? ৬৪ ম্যাচের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নশিপ জয়, আর ১০৪ ম্যাচের বিশ্বকাপের শিরোপা জয় তো এক কথা নয়, কী বলেন?
বিজ্ঞাপন
৩২ দেশের শেষ বিশ্বকাপটি লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার দখলে, এখন দেখার ৪৮ দেশের প্রথম বিশ্বকাপটি কে জেতে! সেই লক্ষ্যে ওয়াশিংটন ডিসির জন এফ কেনেডি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফুটবল আসর—২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপের বহু প্রতীক্ষিত ড্র।
৪৮টি দেশ ১২টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডার যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিতব্য এই মেগা ইভেন্টে অংশ নেবে। বিশ্ব রাজনীতির সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংস্থার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর উপস্থিতি, আয়োজনের উজ্জ্বলতাকে নিয়েছে অনন্য উচ্চতায়।
বিজ্ঞাপন
ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে ৪৮টি দলকে চারটি ভিন্ন পটে ভাগ করে এই ড্র অনুষ্ঠিত হয়। তবে এবারের বিন্যাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো—চারটি করে দল নিয়ে ১২টি গ্রুপ, যেখানে দলগুলো রাখা হচ্ছে A থেকে L পর্যন্ত। স্বাগতিক তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১ নম্বর পটে স্থান পায়।
এখনো ছয়টি দলের জায়গা প্লে-অফ ম্যাচের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে, সেই লড়াইয়ে আছে ইতালিসহ ২২টি দেশ; প্লে-অফের বিজয়ীদের জন্যও নির্ধারিত হয়ে গেছে গ্রুপ—অর্থাৎ বিজয়ী দল কোন গ্রুপে খেলবে সেই হিসাব।
এই নতুন বিন্যাস নিয়ে ফুটবলবোদ্ধাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যেখানে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, দলের সংখ্যা বাড়াতে ছোট দলগুলো আরও বেশি সুযোগ পাবে, সেখানে অনেকের মতে টুর্নামেন্টের গুণগত মান বজায় রাখা কঠিন হতে পারে। তবে ৪৮ দলের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে টুর্নামেন্টের জৌলুস বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ড্র-এর ফলাফল অনুযায়ী, বিশ্ব ফুটবলের হেভিওয়েট ও শীর্ষ র্যাঙ্কিংধারী দলগুলোর সামনে তুলনামূলকভাবে কেমন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা পড়েছে গ্রুপ J-তে। লিওনেল মেসিদের গ্রুপে প্রতিপক্ষ হিসেবে রয়েছে অস্ট্রিয়া, আলজেরিয়া ও জর্ডান। র্যাঙ্কিং ও সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় আর্জেন্টিনা এই গ্রুপে ফেবারিট হিসেবেই শুরু করবে। বিশেষত, আফ্রিকার আলজেরিয়া ও এশিয়ার জর্ডান আর্জেন্টিনার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে অস্ট্রিয়া একটি ইউরোপীয় দেশ হওয়ায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। সামগ্রিকভাবে, আর্জেন্টিনার জন্য এটি তুলনামূলকভাবে সহজ গ্রুপ এটা পরিষ্কার করেই বলা যায়।
লিওনেল মেসিদের গ্রুপে প্রতিপক্ষ হিসেবে রয়েছে অস্ট্রিয়া, আলজেরিয়া ও জর্ডান। র্যাঙ্কিং ও সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় আর্জেন্টিনা এই গ্রুপে ফেবারিটট হিসেবেই শুরু করবে।
আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের জন্য অবশ্য অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ড্র তেমন অনুকূল হয়নি! পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা পড়েছে গ্রুপ C-তে, যেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে রয়েছে মরক্কো, স্কটল্যান্ড ও হাইতি। ২০২২ বিশ্বকাপে মরক্কো যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, তাতে তারা ব্রাজিলের জন্য বড় হুমকি হতে পারে। স্কটল্যান্ডও একটি সুশৃঙ্খল দল। অন্যদিকে, হাইতি অঘটন ঘটাতে সক্ষম। ফলে, ব্রাজিলকে গ্রুপ পর্ব পার হতে হলে বেশ বেগ পেতে হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এটাকে অনেক বিশ্লেষকই একটি গ্রুপ অব ডেথ বলে আখ্যায়িত করছেন। তবে এটিই শেষ নয় গ্রুপ অব ডেথ আরও আছে। চোখ বন্ধ করে আপনি গ্রুপ L-কে আরেকটি ডেথ গ্রুপ বলতে পারেন। এখানে রয়েছে ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, ঘানা ও পানামা। ইংল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস এবং ঘানার সামর্থ্য এই গ্রুপকে কঠিন করে তুলেছে। সুতরাং ব্রাজিল ও ইংল্যান্ডের দুটি গ্রুপকেই বলতে হচ্ছে গ্রুপ অব ডেথ!
ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলোর মাঝে ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেনের গ্রুপে আছে উরুগুয়ে, সৌদি আরব ও কেপ ভার্দে। উরুগুয়ে সবসময়ই কঠিন প্রতিপক্ষ এবং তাদের বিরুদ্ধে জয় পেতে স্প্যানিশদের ঘাম ঝরাতে হবে। সৌদি আরব ও কেপ ভার্দে তাদের জন্য তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ।
আরও পড়ুন
গত আসরের ফাইনালিস্ট ফ্রান্সের গ্রুপে আছে সেনেগাল, নরওয়ে ও প্লে-অফ বিজয়ী একটি দল। সেনেগাল আফ্রিকান ফুটবলে একটি শক্তিশালী নাম। কিলিয়ান এমবাপ্পেদের সামনে সেনেগালের গতি ও শক্তি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
জার্মানির গ্রুপে রয়েছে কুরাসাও, আইভরি কোস্ট ও ইকুয়েডর। ইকুয়েডর ও আইভরি কোস্ট শক্তিশালী দল হলেও জার্মানির জন্য গ্রুপ পর্ব পেরোনো খুব কঠিন হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের গ্রুপে কলম্বিয়া, উজবেকিস্তান ও প্লে-অফ বিজয়ী একটি দল। কলম্বিয়া সবসময়ই একটি বিপজ্জনক দল এবং তারাই পর্তুগালের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন যে দেশ হবে বা ফাইনালে পৌঁছাবে যে দুটি দেশ তাদের আসলে ক’টি ম্যাচ পাড়ি দিতে হবে। ২০২২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে খেলতে হয়েছিল ৭টি ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হেরেও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মেসির দল। এবারে দল বাড়ছে ১৬টি, তবে চ্যাম্পিয়নকে খেলতে হবে আটটি ম্যাচ।
গ্রুপপর্বে কোনো এক ম্যাচে খারাপ করেও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে ফেবারিটরা। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স-আপরা সরাসরি যাবে সেরা ৩২-এ। তৃতীয়স্থান পাওয়া সেরা ৮টি দেশও তাদের সঙ্গী হবে। সুতরাং শুধু ফেবারিটটরা নয়, অনেক মাঝারি মানের দলও ঘুরে দাঁড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ পাবে।
এখন দেখি বিশ্লেষণ কী বলে? ফুটবল পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান অপ্টা’র ভবিষ্যৎবাণী অনুসারে, ড্র-এর আগে শিরোপা জয়ের দৌড়ে স্পেন ছিল শীর্ষে, ১৭ ভাগ ভোট ছিল তাদের পক্ষে। এরপর ফ্রান্স ১৪.১ শতাংশ এবং ইংল্যান্ড ১১.৮ শতাংশ ভোট নিয়ে ছিল পরের দুটি স্থানে।
২০২২ বিশ্বকাপে মরক্কো যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, তাতে তারা ব্রাজিলের জন্য বড় হুমকি হতে পারে। স্কটল্যান্ডও একটি সুশৃঙ্খল দল। অন্যদিকে হাইতি অঘটন ঘটাতে সক্ষম।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার পক্ষে ভোট ছিল মাত্র ৮.৭ শতাংশ, আর ব্রাজিল ছিল সপ্তম স্থানে মাত্র ৫.৬ শতাংশ ভোট নিয়ে। তবে ইংল্যান্ড ও ব্রাজিল গ্রুপ অব ডেথে পড়ায় ড্র-এর পরে এই ভবিষ্যৎবাণী কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। ব্রাজিল কঠিন গ্রুপ পাওয়ায় তাদের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা কিছুটা কমতে পারে, অন্যদিকে আর্জেন্টিনা সহজ গ্রুপ পাওয়ায় তাদের পক্ষে ভোট বাড়বে।
স্বাগতিক দেশগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী ফুটবলাপ্রেমীদের আগ্রহ বেশি থাকে। এবারের স্বাগতিক তিন দেশও ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে রয়েছে। তাদের চ্যালেঞ্জও কম নয়! গ্রুপ A-তে মেক্সিকোকে লড়তে হবে দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে। আন্তর্জাতিক প্লে-অফ থেকে যুক্ত হবে বাকি দেশটি। ডেনমার্ক-চেক প্রজাতন্ত্রের মত দেশগুলোর বিপক্ষে লড়তে হবে তাদের।
গ্রুপ B-তে কানাডার প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড ও কাতারের মতো অভিজ্ঞ দল। মজার ব্যাপার হলো, প্লে-অফ কোয়ালিফাই করলে ইতালি খেলবে এই গ্রুপে। D গ্রুপে যুক্তরাষ্ট্রকে খেলতে হবে অস্ট্রেলিয়া ও প্যারাগুয়ের সাথে, যারা মোটেও সহজ প্রতিপক্ষ নয়। প্লে-অফ খেলে এই গ্রুপে যুক্ত হতে পারে তুরস্কের মতো দেশ।
এখন বোঝাই যাচ্ছে আসন্ন প্লে-অফ ম্যাচের বিজয়ীরা গ্রুপগুলোয় যোগ দেওয়ার পর চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র আরও স্পষ্ট হবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—উত্তর আমেরিকার মাঠে ফুটবলের এই মহাযজ্ঞে প্রতিটি গ্রুপই তার নিজস্ব নাটকীয়তা নিয়ে হাজির হবে, যেখানে দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং অপ্রত্যাশিত ফলাফলের মাধ্যমে রচিত হবে ফুটবলের নতুন ইতিহাস।
আরেকটি লড়াই খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, সেটি হচ্ছে সর্বোচ্চ গোলদাতার দৌড়! ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের জ্যঁ ফন্তেইন ১৩ গোল করেছিলেন, এক আসরে সান্দর ককসিসের ১১ ও জার্ড মুলারেরও আছে ১০ গোলের রেকর্ড! এসব রেকর্ড আর কখনো ভাঙবে না যারা ভাবতেন, নিশ্চয় তারা এবার নড়েচড়ে বসবেন।
এবার একজন ফুটবলার ৮টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবেন, দলগত শক্তির তারতম্যও বেশি। আর তাইতো ভক্ত-সমর্থকদেরও গোলের হিসাব করতে থাকতে হবে ব্যতিব্যস্ত। অপেক্ষা কেবল ১১ জুন ২০২৬-এর, যখন পর্দা উঠবে ইতিহাসের বৃহত্তম বিশ্বকাপ আসরের।
মানজুর মোরশেদ : এডিটর, টি-স্পোর্টস