সীমান্তে টাওয়ার বসিয়ে তথ্য নিচ্ছে মিয়ানমার, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা হুমকির মুখে— জাতীয় গণমাধ্যমের এমন খবরে উদ্বিগ্ন হতেই হলো। মুহূর্তেই ফিরে গেলাম অতীতে। ছয় বছর আগে এই ধরনের একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলাম।

২০১৫ সালের ২১ জুন প্রকাশিত সেই খবরের শিরোনাম ছিল, ‘মিয়ানমারে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক, ব্যবহৃত হচ্ছে চোরাচালান ও মানব পাচারসহ নানা অপরাধে’।

খবরের মূল বিষয়বস্তু ছিল, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের চারটি বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে। এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইয়াবা চোরাচালান ও মানব পাচারকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে। মিয়ানমারে সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশও (বিজিবি) বাংলাদেশি এই মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করছে। ফলে বিজিবি যখন চোরাচালান বা পাচার বিরোধী কোনো অভিযান চালাতে যায় তা বাংলাদেশ থেকে ফাঁস হয়ে যায়।

ছয় বছরে আসলে পরিস্থিতি এতটুকু বদলায়নি। বরং আরও খারাপ হয়েছে। আগে বাংলাদেশের সিমগুলো মিয়ানমারে ব্যবহৃত হতো এবং বাংলাদেশের সব তথ্য সেখানে যেত। এখন উল্টো মিয়ানমার নিজেদের টাওয়ার বসিয়েছে সীমান্তে। রোহিঙ্গারা সেই ফোন ব্যবহার করছে। খুব সহজেই বাংলাদেশের সব তথ্য চলে যাচ্ছে মিয়ানমারে।

বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্ড না থাকার পরেও রোহিঙ্গারা কী করে বাংলাদেশের সিম ব্যবহার করে? আবার মিয়ানমারের সিমও তারা পাচ্ছে কীভাবে?

প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিকম প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস (এমপিটি) সীমান্তে বেশ কয়েকটি টাওয়ার বসিয়েছে। ফলে মংডু সীমান্তসহ আশপাশের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় এমপিটির সিম ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্তের এত কাছে এমপিটির টাওয়ারগুলো আগে ছিল না। ২০১৯ সালের আগস্টের পর এগুলো বসেছে। এরপর গত দেড় বছরে এমপিটি সীমান্তে অন্তত ১২টি টাওয়ার স্থাপন করেছে মিয়ানমার। অথচ ২০১৯ সালের আগে এ সংখ্যা ছিল ‘শূন্য’।
বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থান করা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাজার ধরতে এমপিটি কম দামে সিম কার্ড এবং আকর্ষণীয় মিনিট ও ইন্টারনেটের অফার দিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। অবশ্য শুধু যে মিয়ানমারের সিমই ব্যবহার হচ্ছে তাই নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘুরলে দেখা যাবে, প্রায় সবার হাতেই মোবাইল আছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্ড না থাকার পরেও রোহিঙ্গারা কী করে বাংলাদেশের সিম ব্যবহার করে? আবার মিয়ানমারের সিমও তারা পাচ্ছে কীভাবে?

অবশ্য কীভাবে এই সিম আসে, কীভাবে বিক্রি হয় সবই বিস্তারিত আছে প্রতিবেদনে। ক্যাম্পের অনেক রোহিঙ্গাই এই সিম ও ডাটা ব্যবহার করছে। এছাড়া এমপিটির রিচার্জ কার্ড, মিনিট কার্ড সবই পাওয়া যায় ক্যাম্পে। ফলে ক্যাম্পের যেকোনো ঘটনা সাথে সাথে জেনে যায় মিয়ানমার।

অন্যদিকে মাদক বিক্রি থেকে শুরু করে মানবাপাচার সব কাজেই এই সিম ব্যবহৃত হয় বলে তথ্য জানাচ্ছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমনকি অনেকবারই তারা অপরাধীদের কাছ থেকে এই সিম উদ্ধার করেছে।

কক্সবাজারের ৩৫টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস। এই ১১ লাখের মধ্যে সাত লাখই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর পালিয়ে এসেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন কয়েকদিন আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস বার্গনারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় একটি বৈঠক করেন। তিনি সেখানে বলেছেন, মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে এ সংকটের সমাধান নিহিত রয়েছে মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ওপর, যা গত চার বছরে সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জাতিসংঘ একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করুক। অথচ সেগুলোর কোনটাই হচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার এই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে চুক্তি করার পর বাংলাদেশ মোট ছয় লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। এর মধ্যেই জানা যাচ্ছে সীমান্তে মোবাইল টাওয়ার স্থাপনের কথা। যা সত্যিই আশঙ্কাজনক।

বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জাতিসংঘ একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করুক। অথচ সেগুলোর কোনটাই হচ্ছে না।

বর্তমানে বাংলাদেশের উখিয়া উপজেলার থাইংখালি, রহমতের বিল, পালংখালি, বালুখালি, তমব্রু এলাকা দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করছে। এমপিটির সিম ব্যবহার করে এসব অবৈধ কাজ হচ্ছে। মিয়ানমারের পাশাপাশি বাংলাদেশি মাদক ব্যবসায়ীরাও ব্যবহার করছেন এমপিটির সিম। অপহরণের পর মুক্তিপণ চেয়ে যোগাযোগও হচ্ছে এমপিটিতে।

নানা অপরাধে কক্সবাজার-মিয়ানমার সীমান্তে সিম ব্যবহার হয়ে আসছে অনেকদিন ধরেই। ২০১২-২০১৫ সালে কক্সবাজারের বঙ্গোপসাগর দিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মানব পাচারের ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচিত ছিল। আর ইয়াবা চোরাচালানে তো বহু পুরনো ঘটনা। সেই সময়ও মাদক ও মানব পাচারকারীরা মুঠোফোন সিমের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখেছেন। তবে তখন মিয়ানমার সীমান্তে পাচারকারীরা ব্যবহার করতো বাংলাদেশি সিম।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিজিবির কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে আনা কিংবা সাগরে পাচারের জন্য লোক আনা-নেওয়া—সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের অপরাধী চক্র বাংলাদেশের মুঠোফোন ব্যবহার করেছে। এছাড়া সার, ডিজেল, ওষুধ, সিমেন্ট, চাল পাচারকারীরাও এসব মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকে।

মিয়ানমারে সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশও (বিজিবি) বাংলাদেশি নম্বর ব্যবহার করছে। ফলে বিজিবি যখন চোরাচালান বা পাচার বিরোধী কোনো অভিযান চালাতে যায় তা অনেক সময় বাংলাদেশ থেকে ফাঁস হয়ে যায়।

স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিবির কর্মকর্তারা তখন অভিযোগ করেছিলেন, বারবার বিটিআরসিকে বলা হলেও তারা মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের ব্যবহার বন্ধ করতে পারেনি। ছয় বছর পর এসে এখনো প্রায় একই রকম কথাই শোনা যাচ্ছে।
মিয়ানমারের সিম বাংলাদেশে ব্যবহার করার পরেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, তারা বিষয়টি জানেন। কিন্তু অন্য একটি দেশের ফ্রিকোয়েন্সি বা নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ বা ব্লক করা প্রায় অসম্ভব। তবে উপায় বের করতে হবে। না হয় ভয়ানক বিপদ অতি নিকটেই।

নীতিনির্ধারকদের কাছে অনুরোধ, দ্রুত যেন সেই কাজটি করা হয়। পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতে এমপিটি সিম ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধে অভিযান চালানো উচিত। ক্যাম্পগুলোতে অপ্রীতিকর যেকোন ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেটি যেমন জরুরি পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে তথ্যপাচার বন্ধ, মানব পাচারসহ নানা অপরাধ ও জঙ্গিবাদ দমনসহ বহু কারণেই সেটি করতে হবে। যতদিন না এই নেটওয়ার্ক বন্ধ হচ্ছে ততদিন উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে।

শরিফুল হাসান ।। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক