সম্প্রতি দেশে জ্বালানি তেল (ডিজেল ও কেরোসিন) এর দাম বাড়ানো হলো আর এর পেছনে যে দুটি যুক্তি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে তা হলো, প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সমন্বয় করা আর দ্বিতীয়ত, পার্শ্ববর্তী দেশে আমাদের চাইতেও ডিজেলের দাম বেশি হওয়ার কারণে তেল পাচার রোধ করতে কৌশলগত একটা পদক্ষেপ।

এই দুটো কারণ কতটুকু যৌক্তিক বা অযৌক্তিক সে বিশ্লেষণে যাচ্ছি না, তার আগেই এই তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে। আর যে দেশে যাত্রী আর মালামালের ৭০ শতাংশই পরিবহন হয় সড়ক পথে সেই দেশে তেলের দাম বৃদ্ধির প্রথম ধাক্কা আসে মানুষের যাতায়াত আর নিত্যপণ্য বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্যের উপর।

ইতিমধ্যে প্রায় সবধরনের যানবাহনের ভাড়া বেড়ে গিয়েছে এর ফলে বাড়বে সবকিছুর দাম। সাধারণ মানুষ আন্তর্জাতিক বাজার বোঝে না বা সীমান্তে জনগণের করের টাকায় গড়ে তোলা এত নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে কীভাবে তেল পাচার হবে সেই হিসাবও নিতে যায় না, সে বোঝে সকাল হলেই তাকে বাসে উঠতে গেলে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে বা ডালের সাথে হয়তো পানিটা একটু বেশি মেশাতে হবে যাতে খাবার খরচটা কিছুটা কমে।

যে দেশে যাত্রী আর মালামালের ৭০ শতাংশই পরিবহন হয় সড়ক পথে সেই দেশে তেলের দাম বৃদ্ধির প্রথম ধাক্কা আসে মানুষের যাতায়াত আর নিত্যপণ্য বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্যের উপর।

আমাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্তের দায় নেওয়া এই মানুষগুলো জীবনে পিছলে যেতে যেতে হয়তো এটাও ভাবে যে, তেলের দাম বাড়ালে সেটা পোষাতে কি ভাড়া বাড়াতেই হবে? এই সমাধান তো সবাই পারে, এর জন্য কি এত মেধার দরকার হয়? বরং দেশের নীতিনির্ধারকদের যাদের বাসে চড়তে হয় না, যারা শেষ কবে বাজারে গিয়েছে সেটাই হয়তো ভুলে গেছে, তারা কি অন্য কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা করতে পারত না, যাতে সাধারণ মানুষগুলোর উপর কোনো বাড়তি খরচের চাপ পড়ত না, এ যাত্রায় কিছু টাকা বেঁচে যেত? এর উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই যেত কিন্তু সেই বিকল্পগুলো নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নকারী বা নীতিনির্ধারকরা হয়তো চিন্তাই করেনি আবার অন্যদিকে মালিকপক্ষ সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দেইনি ভালো একটা পরিকল্পনা গ্রহণের।

তেলের দাম বাড়ার পর বাসের ভাড়া বাড়ানোর একটা প্রস্তাব মালিকপক্ষ দিয়েছে কিন্তু তার আগেই তারা সব গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে, যার ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ জনগণ।

কোনো দাবি আদায় করার কিছু ধাপ থাকে কিন্তু মানুষের ভোগান্তি হবে জেনেও প্রথমেই গণপরিবহন বন্ধ করে সরকারকে চাপে ফেলে আলোচনার টেবিলে বসলে সেটা যতটা না আলোচনা তার চাইতে বেশি হয় ‘হুমকি দিয়ে আদায় করা’। অন্যদিকে এটাও সত্য যে, আচমকা একরাতের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করলে মালিকদের জন্য পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাবে এবং এ বাস্তবতায় যদি কোনো মালিক তার গাড়িটি রাস্তায় বের না করে তাহলে তাকে কতটুকুই বা দোষ দেওয়া যাবে।

দেখা গেল যে, তেলের দাম বৃদ্ধির পর একসাথে সকল যাত্রী ও পণ্য পরিবহনকারী যান বন্ধ হয়ে গেল। এখানে একটা বিষয় হলো যে, সব গণপরিবহন কি ডিজেলে চলছে? একটা সময় যখন গ্যাসের দাম অনেক কম ছিল ডিজেলের তুলনায়, তখন বেশিরভাগ মালিক তার গাড়িটি গ্যাসে চালনার জন্য রূপান্তরিত করেছিল। কিন্তু এর ফলে গাড়ির ইঞ্জিনসহ আরও কিছু উপাদানে সমস্যা দেখা যাওয়ায় এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে বেশিরভাগ মালিক তার গাড়িটি পুনরায় ডিজেলে চালাচ্ছে। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, যেসব গণপরিবহন গ্যাসে চলে সেগুলোও বন্ধ করে রাখা হলো এবং তা কি কারণে রাখা হলো তার ব্যাখ্যা কি সরকার চেয়েছে?

সরকার এটা জানতে না চাইলেও জনগণ কিন্তু দেখে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকরা ভাড়া বৃদ্ধি করেও জনগণের সাথে প্রতারণা করে আসছে। তারা বর্ধিত ভাড়ার চাইতেও বেশি ভাড়া আদায় করে বিভিন্ন অজুহাতে। আর যাত্রীরাও একরকম জিম্মি হয়ে থাকে কারণ তাদের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই এবং কোন গাড়ি তেলে চলছে আর কোন গাড়ি গ্যাসে চলছে সেটাও বলে না দিলে যাত্রীর জন্য বুঝতে পারা কষ্টকর। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকরা ভাড়া বৃদ্ধি করেও জনগণের সাথে প্রতারণা করে আসছে। তারা বর্ধিত ভাড়ার চাইতেও বেশি ভাড়া আদায় করে বিভিন্ন অজুহাতে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে যে সময় লাগে সরকার চাইলে সেই সময় তেলের দাম না বাড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারত। আর একান্তই যদি তেলের দাম বাড়াতেই হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে গণপরিবহনে জন্য জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিতে পারে। এক্ষেত্রে অন্য সব যানবাহনের জন্য তেলের দাম বর্ধিত হার থাকলেও বাস / ট্রাকের জন্য পূর্বের দাম রাখা যেতে পারে কিছুদিন। এ সবগুলোই হলো স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা, কিন্তু ক্রমাগত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকলে আমাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।

অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের পরিশোধিত করার প্রক্রিয়ায় খরচ কমানোর চিন্তা করা যেতে পারে। পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর না করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প উৎস ও ব্যবহার বের করতে হবে। সবচাইতে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এ বিষয়ে গবেষণা বৃদ্ধি করা যাতে করে অন্যান্য বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা যায়। এতকিছু বিবেচনা না করে আমরা সহজ সিদ্ধান্ত নিলাম আর সেটা হলো ভাড়া বৃদ্ধি।

শুধু তাই না, আমাদের দরকার একটা বিশ্বাসযোগ্য ডাটাবেজ যেখানে যানবাহনের বিভিন্ন তথ্যের সাথে সাথে কোন ধরনের জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে তাও উল্লেখ থাকবে। তেলের দাম বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে যদি গ্যাসে চালিত গাড়িও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে চায় তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রতিদিন বিআরটিএতে, যে বাস-ট্রাক ফিটনেস নবায়ন করতে আসে সেগুলোর গায়ে দৃশ্যমান স্থানে জ্বালানির ধরন উল্লেখ করা যেতে পারে যাতে তারা জনগণকে বোকা বানাতে না পারে। মনে রাখতে হবে, বিকল্প উপায় এখনই না ভাবলে এবং পাশাপাশি অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শুধুমাত্র দাম / ভাড়া বৃদ্ধি কখনো স্থায়ী সমাধান আনতে পারবে না।

করোনার ক্ষয়ক্ষতি আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসা হারিয়েছে বা কোনোমতে টিকে আছে জীবন যুদ্ধে। সবকিছু পেছনে ফেলে মানুষগুলো কিন্তু একটু একটু করে আগাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে তেলের দাম বৃদ্ধি করে এবং তার বিপরীতে সবকিছুর দাম বৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়ে আমরা তাদের এই চলার পথটা আরও পিচ্ছিল করে দিলাম কি না সেটা একবার ভেবে দেখবেন আমাদের নীতিনির্ধারকরা।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট