প্রেসক্লাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় বিএনপি নেতারা/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আসেনি বলে দাবি করছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির নেতারা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ অবশ্যই ঐতিহাসিক এবং জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিল। কিন্তু সেদিন তিনি দেশের স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দেননি।

রোববার (৭ মার্চ) সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় দলটির নেতারা এ কথা বলেন। স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীতে বিএনপির দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৭ মার্চ উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

দলটির সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অনেকে আমাদের প্রশ্ন করেছেন, আপনারা আগে তো ৭ মার্চ পালন করেননি। আমাদের পরিষ্কার জবাব, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর একটি দিন হিসেবে আমরা ৭ মার্চ পালন করছি। সুবর্ণজয়ন্তী ইতোপূর্বে আর কোনো দিন আসেনি।’

‘৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অবশ্যই ঐতিহাসিক এবং জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওই ভাষণে ঐক্যবন্ধ হওয়ার জন্য কিছু নির্দেশনা ছিল। এটা আমরা অস্বীকার করতে চাই না। সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান। এটাও আমরা অস্বীকার করি না। জিয়াউর রহমান যতবার জাতির উদ্দেশে আনুষ্ঠানিক ও সংসদে বক্তব্য রেখেছেন, সেখানে স্বাধীনতার জন্য অবদান রাখাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নামও স্মরণ করেছেন। খালেদা জিয়াও যতবার জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছেন, সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছিল। আমরা কারও নাম ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চাই না।’

তিনি বলেন, ‘‘এই ৭ মার্চ আমরা পালন করব এমন ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়ায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি যে ৭ মার্চ পালন করছে, এটা বলার জন্য যে একটি ভাষণ স্বাধীনতা এনে দেয়নি।’ তিনি তা অগ্রিম চিন্তা করলেন। তিনিই তো বলে দিয়েছেন, আমরা তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বলছিলাম, একটি ভাষণ স্বাধীনতা এনে দিতে পারে না।’’

বিএনপির এই নেতা মনে করেন, এই ভাষণ নিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে যেভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। এ ভাষণের কিছুটা বিকৃত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ কয়েকটি কথার ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান এও বলেছিলেন যে, ‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ তাহলে তো বলা যেতেই পারে সে সময় পাকিস্তানের তৎকালীন সময়ের সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির অংশ হিসেবেই তিনি এই কথা বলেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বক্তব্য নিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘সংগ্রাম ও মক্তিযুদ্ধকে বর্তমান সরকার এটাকে এক সঙ্গে করে দিচ্ছে। সংগ্রাম ও যুদ্ধ এক হতে পারে না।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের দিনটি স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘তখন বিএনপি ছিল না। জিয়াউর রহমানকেও বাংলাদেশের মানুষ চিনত না। ৭ মার্চের আলোচনায় আমরা কোনো দলকে ছোট করার জন্য আলোচনা করতে আসিনি। এখানে তুলনা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। জিয়াউর রহমান এখানে বিষয়বস্তু না। আমরা ইতিহাসকে বিবৃত করার জন্য এখানে আলোচনা করতে আসি নি।’

২ মার্চ পতাকা উত্তোলন দিবসের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজকে যারা ইতিহাসকে বিকৃত করছে তারা ওই দিনগুলোকে মনে করতে চায় না।’

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রসঙ্গে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘এর আগে ছাত্র সমাজ যেখানে পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেছে, স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র সমাজ, সারা বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল, ৭ মার্চ, স্বাধীনতার ঘোষণা করা হবে। যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা এখানে বক্তব্য রেখেছেন। আমি তখন উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে ছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘এটাকে বিবেচনা করতে হবে, তখনকার ছাত্র সমাজ ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য যে প্রত্যাশা করেছিল, সে দিনের ভাষণে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।’

দলটির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘রেসকোর্সে ৭ মার্চের ভাষণের সময় আমি ঠিক মঞ্চের সামনেই উপস্থিত ছিলাম। ওই ভাষণের পুরোটাই আমি শুনেছি। এখনও শুনছি। কিন্তু বক্তব্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ যা কিছু খুঁজে পেয়েছে, আমরা কিন্তু তা খুঁজে পাইনি। ওইদিন আমরা রেসকোর্স ময়দানে বাঁশ নিয়ে গিয়েছিলাম, আমরা মনে করেছিলাম স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে। দেখলাম, কোনো ঘোষণা আসেনি। তাই যদি কেউ বলে এক জন মেজরের ঘোষণায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। তাহলে আমরাও বলব, ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তথা পুরো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে জয়ী হওয়ার পরে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সে আন্দোলনের প্রেক্ষাপটই হচ্ছে ৭ মার্চের জনসভা। আমার কাছে খুব অবাক লাগে যখন দেখি, যারা বিনা ভোটে ক্ষমতা দখল করে আছে তারা কি ভুলে গেছে সেই প্রেক্ষাপটের কথা? সেই প্রেক্ষাপট ছিল, গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপট। সেই প্রেক্ষাপট ছিল বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার রক্ষার প্রেক্ষাপট।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজকে যারা ক্ষমতা দখল করেছে, তারা যখন ৭ মার্চের কথা উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকে, তারা কি ভুলে গেছে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক মাইলফলকের মধ্যে ৭ মার্চ সত্যি একটি মাইলফলক। মুক্তিযুদ্ধের অনেক মাইলফলক হারিয়ে গেছে। কিন্তু এগুলো এখন আর কেউ স্মরণ করে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বিএনপি পালন করছে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসকে জানানোর জন্য।’

স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘‘আমরা রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতায় শুনতে আশা নিয়ে বসেছিলাম যে, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। ২০ মিনিট বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বক্তৃতায় ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একটা গুলি চললে পাল্টা গুলি চলবে’। কিন্তু সেখানে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। শেষে ওনার বক্তব্য ছিল, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি সেদিন স্বাধীনতার ভাষণ দিয়েছেন। স্বাধীনতার ভাষণ আর ঘোষণা এক জিনিস না। তাই আমি বলছি ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ঘোষণা না।’’

এএইচআর/এফআর