পৃথিবীর অন্যতম একটি শব্দ ‘মা’ যার সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। বিশ্বজুড়ে অন্যান্য সম্পর্কের মধ্যে অন্যতম মায়ের বন্ধন। যার ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই। আর সেই মানুষটি যদি না থাকে তাহলে অনুভূতি কেমন লাগবে সেটা প্রকাশ করার ভাষা কারও জানা আছে?

মাকে হারিয়ে পঁচিশ বছরের বেশি একাকী পথ চলছি। বোবা কান্নায় জীবনটা পাথরে পরিণত হয়েছে। সুখে দুঃখে সময় চলে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেখানে কোনো মমতা নেই। ছিমছাম ঝঞ্ঝাটমুক্ত একটা পরিবারে বেড়ে ওঠা। মায়ের স্নেহ আঁকড়ে পড়াশোনায় একজন ভালো ছাত্র হিসেবে ছাত্রজীবনের অর্ধাংশ কাটে। কিন্তু যে, স্বপ্ন সাধনা ছিল পড়াশোনায় তা আর পূরণ হয়নি কৈশোরে মাকে হারিয়ে।

মায়ের ভালোবাসা, শাসন থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত উঠতি বয়সেই। এক কথায় সমাজ, সংসার পৃথিবীকে বোঝার আগেই মা মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমাকে রেখে চিরতরে বিদায় নেন। মায়ের আদর, স্নেহ মনে যে, আত্মতৃপ্তি দেয় তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতির মাত্রা বাড়তে থাকে যা আগে কখনও বুঝিনি।

পড়াশোনায় উচ্চ সিঁড়িতে নিজেকে অধিষ্ঠিত করার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেই স্বপ্ন বহু দূরে। তবু এখনও থেমে নেই, সুযোগকে কাজে লাগাবার চেষ্টা রয়েছে শত ব্যস্ততার মাঝেও। দুঃখের বিষয় মায়ের মৃত্যুর পর থেকে বিদেশে জীবনের অর্ধেক সময় পার করে দিয়েছি। কাজকর্ম, পড়াশোনা, সংসার বাস সবই এখন দেশান্তরে।

এর ফলে অনুভূতির জায়গাটুকু বেশি পীড়া দেয়। বিশেষ করে যখন বিশেষ কোনো দিন আসে যেমন মাকে নিয়ে কথা বলার অন্যান্য সুযোগ ‌‘মা’ দিবস। মায়ের সঙ্গে অতীতের সব কিচ্ছা-কাহিনী এই দিবসটি এলে প্রতিচ্ছবি হয়ে চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। মন চায় মাকে একটু কাছে পেতে, মায়ের হাতে নানা রকমের রান্না এবং অনেক স্বাদের ভর্তা যা ভাবলে মুখে লালা আসে জিহ্বায়। শেষ কবে মায়ের হাতের রান্না খেয়েছি কোনোভাবেই মনে পড়ছে না। কারণ বয়স তো হয়নি বোঝার। তবে একটা কথা খুব বেশি মনে পড়ে। মা আশপাশের সব ছোট-বড় আমার সমবয়সী কিংবা একটু বড় তাদেরকে মা বোন হিসেবে সমর্থন করতেন। যদিও বিষয়টি খুব বিরক্তিকর ছিল। নিজের সমবয়সী মেয়েদের আন্টি/খালামনি ডাকতে নিজের কাছে অস্বস্তি লাগতো। এর রহস্য বের করতে সময় লেগেছে। তবে এটা আমার মঙ্গলের জন্যই তিনি এ চালাকির পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাই কৌতূহলবশত একদিন প্রশ্ন করলাম। মা সেতো আমার বয়সী তাহলে তুমি বোন বললে তাকে আমার আন্টি বলতে হবে এটা কীভাবে সম্ভব। মা বললেন, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে নেই। তাহলে জ্ঞানের পরিধি হ্রাস পাবে। পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাবে। তাছাড়া সময় হলে সব বুঝতে পারবে। ঠিকই, বুঝেছি যা ভেবেছিলেন মা। মায়ের স্মৃতির যতটুকু মনে আছে ততটুকু স্মৃতি চারণ করতে গেলে লেখার পরিধি এত বড় হবে যে, পরে নিজের অজান্তে খেই হারিয়ে ফেলব।

মা এমন একটি শব্দ, জগত সংসারে মধুর চেয়েও বড় মিষ্টি। এর তাৎপর্য বর্ণনা করতে গেলে কলমের কালি শেষ হবে তবু গুরুত্বের বর্ণনা অবশিষ্ট থেকেই যাবে। এমন আরেকজন পাওয়া যাবে এই দুনিয়ায় যে, দীর্ঘ নয় মাস শত জ্বালা, যন্ত্রণা সহ্য করে পেটে লালন করবে। নিজের আনন্দ, আহ্লাদ জলাঞ্জলি দেবে। উঠতে, বসতে এমনকি বিশ্রামের সময় সীমাহীন কষ্ট সহ্য করবে। কিন্তু মা তা করে। সেজন্য মায়ের তুলনা শুধুই মা। পৃথিবীর কোথাও যখন নিরাপদ মনে হবে না নিঃসন্দেহে মায়ের কোল সব সময় নিরাপদের কেন্দ্রস্থল। এই হল ‘মা’ মানুষ, ছেলেমানুষি দুটি সময় করে এক শিশুকাল আরেক বৃদ্ধকাল। দুঃখের বিষয় মা যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় তার কোনো কথাই আমরা আমলে নেই না। এমনকি তার প্রতি যতটুকু দায়িত্ববোধ তা-ও যথাযথ পালন করি না। মর্যাদার আসনটি অবহেলায় রেখে দে-ই। একবার ভাবি না যে, কাজটি আমি করছি এখন। এই কাজটি যদি মা করতেন তবে পৃথিবীর আলোর মুখ কখনও দেখা হতো না। এসব ভেবে অন্তত মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত ময়ের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। মনে রাখতে হবে, মায়ের উহঃ শব্দ হতে পারে আমার, আপনার লানতের বড় কারণ। তাই মায়ের প্রতি আমাদের সম্মানবোধ সদা একই থাকা উচিত।

মায়ের ভালোবাসার কাছে সব ভালোবাসা তুচ্ছ এবং নগণ্য। মাঝেমাঝে কিছু ঘটনায় ভীষণ কষ্ট লাগে মনে, ছেলে/সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার পরও মায়েদের স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে যা খুবই দৃষ্টিকটু। লজ্জাহীন মনুষ্যত্বের পরিচয় দেন এসব মানুষরা। এসব সন্তানরা সমাজের কীট হিসেবে পরিচিত। মায়ের সম্মান ধরে রাখতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হয় না। শুধু সৎ বিবেক অর্জন করতে হবে। যার মা জীবিত আর যার মা দুনিয়ায় নেই। সে-ই জানে মায়ের অভাবনীয় অপূর্ণতা। আমার কষ্টের মাত্রা বাড়ে প্রতিটি আনন্দ উৎসবের দিনে। এই দিনগুলোতে মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে। কখনও কখনও মন থমকে পৃথিবী একেবারে মূল্যহীন হয়ে যায়। চলুন আমরা সবাই মাকে সম্মান করা শিখি।

লেখক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব