ইসলামে আনসার ও মুহাজির বলা হয় যাদের
প্রতীকী ছবি
ইসলামের সূচনালগ্নে মক্কার মুসলিমরা এক কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। আপন গোত্রের অবিশ্বাসী কাদেরদের অবিচার ও নিপীড়ন তাদেরকে স্বদেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। মক্কার কাফিরদের অত্যাচারের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে গেলে মহানবী (সা.) তাদের মদিনায় হিজরত করার অনুমতি দেন। তখন মদীনার মুসলমানরা সহযোগিতা ও সহানুভূতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
মদিনার হিজরতকারী মক্কাবাসী মুসলমানদের সহোদর ভাইয়ের মতো সাদরে গ্রহণ করে আশ্রয় দেন, তারা নিজেদের প্রয়োজন ও দারিদ্র্য সত্ত্বেও মক্কার সহায়-সম্বলহারা মুসলমান ভাইদের জন্য ধন সম্পদ ও আপন স্বার্থ ত্যাগ করেছিলেন। মদিনার এই সাহায্যকারী মুসলিমদের আনসারি সাহাবি বলা হয়।
বিজ্ঞাপন
অপর দিকে মক্কার কাফেরদের অত্যাচার ও নিজের দ্বীন-ঈমান রক্ষার জন্য মদিনায় হিজরতকারী সাহাবিদের মুহাজির বলা হয়।
ইসলামের ইতিহাসে আনসার ও মুহাজির সাহাবীদের ভ্রাতৃত্ববন্ধন স্মরণীয়। ইতিহাসে এমন বন্ধন আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না। ইসলামের জন্য নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে মদিনায় আসা মুহাজির সাহাবিদের নিজেদের জন পৈতৃক সম্পত্তিও সমভাবে ভোগ করার অধিকার দেয় আনসার সাহাবিরা। বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের স্বার্থত্যাগের ঘটনা বিরল।
বিজ্ঞাপন
আনসার সাহাবিদের পরার্থপরতার এ গুণটি পছন্দ করে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন-
وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۫ؕ
তারা (আনসারেরা) নিজেদের উপর (মুহাজিরদের) প্রাধান্য দেয়। যদিও নিজেদের প্রয়োজন ও অভাব থাকে। -(সূরা হাশর, আয়াত, ০৯)
মদিনার এ স্বার্থত্যাগী ভাইয়েরাই ইসলামে আনসার বা সাহায্যকারী নামে পরিচিত। আনসারদের অবদানের ফলে ইসলামের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা অনেকটা সহজতর হয়। ইসলামের প্রাথমিক বিপ্লব সাধনে আনসারদের অবদান চিরস্মরণীয়। তাঁদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় মাত্র ১০ বছরের মধ্যে সারা বিশ্বে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়ে।
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিয়েছিলেন। সুন্দর শৃংখলার জন্য মুহাজির ও আনসারের কে কার সাথে বসবাস করবেন সেটাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।
আবদুর রহমান বিন আউফের ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিলেন আনসারী সাহাবী সাদ বিন রবীর সঙ্গে। তিনি আবদুর রহমান বিন আউফকে ঘরে নিয়ে গেলেন। এরপর তাকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই আবদুর রহমান! আজ থেকে আমার অর্ধেক সম্পদের মালিক তুমি। আর শোনো, আমার দুজন স্ত্রী রয়েছে। তোমার যাকে পছন্দ হয় বল, আমি তাকে তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষ হলে তুমি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
আবদুর রহমান বিন আউফ রা. জবাবে বললেন, ভাই সাদ! আল্লাহ পাক তোমার সম্পদ ও পরিবারে বরকত দান করুন। তোমার সবকিছু তোমার কাছেই থাক। আমাকে শুধু বাজারের রাস্তাটা দেখিয়ে দাও। আমি ব্যবসা করতে চাই। সাদ বিন রবী রা. তাকে বনু কায়নুকার বাজার দেখিয়ে দিলেন।
তিনি সেখানে গিয়ে বেচা-কেনা শুরু করলেন। প্রথম দিনই কিছু টাকা লাভ হল। তা দিয়ে তিনি খাওয়ার জন্য কিছু ঘি ও মাখন কিনে আনলেন। এভাবে তার ব্যবসায় দিন দিন উন্নতি হতে লাগল। নিজ হাতের উপার্জনের মাধ্যমেই তিনি আস্তে আস্তে সচ্ছল হয়ে উঠলেন। এরপর এক আনসারী নারীর সাথে তার বিবাহ হল। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৮৬৩; মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, হাদীস ১৩৩৩)
আনসার সাহাবীদের মুসলিম ভাইদের জন্য স্বার্থত্যাগ এবং মুহাজিরদের পক্ষ থেকেও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের বেশ কয়েকটি ঘটনা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
হজরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, আনসার সাহাবীগণ নবীজীকে বললেন, আমাদের খেজুর বাগানগুলো মুহাজির ভাই ও আমাদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করে দিন। নবীজী তাদের এ প্রস্তাব নাকোচ করে দিলেন। তাই আনসারগণ মুহাজিরগণকে বললেন, তোমরা শুধু আমাদেরকে চাষাবাদের কাজে সাহায্য করবে আর আমরা তোমাদেরকে ফসলের ভাগ দিব। অবশেষে তারা সকলেই এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। -(সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩২৫,২৭১৯)
আরেক হাদিসে হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, মুহাজিরগণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যে ভাইদের নিকট আমরা আশ্রয় গ্রহণ করেছি তাদের চেয়ে উত্তম মানুষ আর দেখিনি। তারা সামান্য বিষয়েও আমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায় এবং আমাদের জন্য প্রচুর সম্পদ বিসর্জন দেয়। আমরা শুধু তাদের বাগান ও জমির কাজে সহযোগিতা করি। এতেই তারা আমাদেরকে ফসলের সমান ভাগ দেয়। আমরা আশংকা করছি, তারাই (আখেরাতের) সমস্ত প্রতিদান নিয়ে যাবে।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। যতক্ষণ তোমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে এবং তাদের জন্য দুআ করবে। (তোমরাও প্রতিদান পাবে।) -(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩০৭৫; সুনানে নাসাঈ, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লা ১৮১)
আরেকটি হাদিসে হজরত আনাস রা. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, (বাহরাইন বিজিত হওয়ার পর) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আনসার সাহাবীদের নামে লিখে দিতে চাইলেন। তারা এ প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। আর আবেদন জানালেন, আমাদেরকে যে পরিমাণ সম্পদ দেয়া হবে মুহাজির ভাইদেরও যেন সেই পরিমাণই দেয়া হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমরা (মুহাজিরদেরকে রেখে কোনো কিছু) নিতে সম্মত না হও তাহলে ধৈর্যধারণ করতে থাকো হাউযে কাউসারের নিকট আমার সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হওয়া পর্যন্ত। কেননা, ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিষয়ে তোমাদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেয়া হবে। -(সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৯৪, ২৩৭৬, ২৩৭৭)
মুহাজিরদের পাশাপাশি আনসাররা প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ইসলামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। তাদের আন্তরিকতায় মহানবী (সা.) মদিনায় একটি স্থায়ী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। দ্বিন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। আনসারদের এই আত্মত্যাগের ঘটনা সর্বকালের মুসলমানদের জন্য অসীম প্রেরণার উৎস।
এনটি