দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতর। ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধুতা ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে। আনন্দ ও আপন রবের সামনে নিজেকে সপে দেওয়ার বার্তা নিয়ে আসে ঈদ।

ইসলামে ঈদের প্রবর্তন হয়েছে দ্বিতীয় হিজরির মাঝামাঝি সময়ে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন মদিনায় আসেন, তখন দেখেন যে সেখানকার লোকরা বছরে দুদিন (নওরোজ ও মেহেরজান) আনন্দ করে, খেলাধুলা করে। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের এ দুদিনের পরিবর্তে আরও বেশি উত্তম ও কল্যাণকর দুটি দিন দিয়েছেন। ১. ঈদুল আজহা। ২. ঈদুল ফিতর। (আবু দাউদ, হাদিস : ১/১৬১)

ঈদের দিনের বেশ কিছু সুন্নত সুন্নত ও মুস্তাহাব আমল রয়েছে। সব তুলে ধরা হলো এখানে-

১. সদাকাতুল ফিতর আদায় করা। রোজার মাধ্যমে রোজাদার কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছেন সারাবছর অনাহারে থাকা মানুষের কষ্ট। অন্ন-বস্ত্রহীন ভাইদের কষ্ট। সাথে সাথে রোযা রাখতে গিয়ে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে সেগুলো থেকে নিজেও যেন পুত পবিত্র হতে পারে। সেজন্য বিত্তবানদের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে সদাকাতুল ফিতর। 

হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল (সা.) সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন রোজাদারকে অর্থহীন ও অশ্লীল কথা কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থা হিসাবে। যে (ঈদের) নামাযের পূর্বে তা আদায় করবে তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে নামাযের পর আদায় করবে তা সাধারণ সদাকা হিসাবে বিবেচিত হবে। (আবু দাউদ : ১৬০৯)। তাই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই সদাকাতুল ফিতর আদায় করে দেয়া মুস্তাহাব। 

২. এদিন পানাহারের দিন।

পুরো মাস রোযা রাখার পর আজ বান্দার আনন্দের দিন। তাই আল্লাহ তায়ালা এদিন রোজা রাখা হারাম করেছেন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল (সা.) দুই দিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। ইয়াওমুল ফিত্র তথা ঈদুল ফিতরের দিন এবং ইয়াওমুন নহর তথা কুরবানীর ঈদের দিন। (মুসলিম : ১১৩৮)।

৩. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খেজুর বা মিষ্টিমুখ করা। 

যেহেতু ঈদের দিন রোজা রাখা নিষেধ তাই এর প্রকাশ হিসাবে মুস্তাহাব হল ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কয়েকটি খেজুর খেয়ে যাওয়া এবং এক্ষেত্রে বেজোড় সংখ্যার প্রতি লক্ষ রাখা। খেজুরের ব্যবস্থা না থাকলে অন্য কোনো মিষ্টান্ন গ্রহণ করা। 

হযরত আনাস রা. বলেন, রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরে খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। তিনি বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন। (বুখারী : ৯৫৩)।

এই আমল হল ঈদুল ফিতরের জন্য। ঈদুল আযহার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হল না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং কুরবানীর গোশত দিয়ে সর্বপ্রথম আহার গ্রহণ করা। রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরে না খেয়ে বের হতেন না আর ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহ হতে ফেরার পূর্বে কিছু খেতেন না। ঈদগাহ থেকে ফিরে পশু জবাই করার পর নিজ কুরবানীর পশুর গোশত থেকে খেতেন। (মুসনাদে আহমাদ : ২২৯৮৪)।

৪. গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া।

 ঈদের দিন গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম গোসল করে ঈদগাহে যেতেন। হযরত নাফে রাহ. বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করে নিতেন। (মুয়াত্তা মালেক : ৪৮৮)।

৫. উত্তম পোশাক পরিধান করা। 

সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা এবং বৈধ সাজগোজ গ্রহণ করা মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম এমনটি করতেন। নাফে রাহ. বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) দুই ঈদে উত্তম পোশাক পরতেন। (সুনানে কুবরা : ৬১৪৩)। অতএব ঈদের দিন সাধ্যানুযায়ী উত্তম পোশাক পরা মুস্তাহাব। তবে উত্তম পোশাক অর্থ নতুন পোশাক নয়। নিজের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে ভালো পোশাক পরা।

৬. ঈদের দিন বেশি বেশি তাকবীর বলা।

তাকবীর হল, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। ঈদগাহে যাওয়ার সময় বিশেষ গুরুত্বের সাথে তাকবীর বলতে থাকবে। নাফে রাহ. বলেন, ইবনে উমর রা. ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের সকালে সশব্দে তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যেতেন এবং ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবীর বলতে থাকতেন। (সুনানে দারাকুতনী : ১৭১৬)।

৭. এক পথে যাওয়া আরেক পথে ফেরা।

সম্ভব হলে ঈদগাহে যাওয়ার সময় এক পথে যাওয়া আর ফেরার সময় ভিন্ন পথে আসা। নবীজী এমনটি করতেন। হযরত জাবের রা. বলেন, নবীজী ঈদের দিন এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যেতেন আর ভিন্ন পথ দিয়ে ফিরতেন। (বুখারী : ৯৮৬)

৮. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। 

যতটুকু সম্ভব পাঁয়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। হযরত ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল (সা.) ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যেতেন এবং পায়ে হেঁটে ফিরতেন। (ইবনে মাজাহ : ১২৯৫)।

৯. একে-অপরের জন্য দোয়া করা। 

ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম দোয়া সুলভ বাক্যে সৌজন্য বিনিময় করতেন। তাবেয়ী জুবাইর ইবনে নুফাইর বলেন, রাসূল (সা.) -এর সাহাবীগণ ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাতে বলতেন, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের এবং তোমার আমলগুলো কবুল করুন। (ফাতহুল বারী ২/৪৪৬)। এরকম সৌজন্য বিনিময়ের মাধ্যমে উত্তম আচরণ প্রকাশিত হয় এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় হয়।

১০. ঈদের নামাজের কেরাত। ঈদের নামাজের জন্য বিশেষ কোনো সূরা নির্ধারিত নেই। তবে হাদীসে পাওয়া যায় নবীজী কোন কোন সূরা দিয়ে ঈদের নামায পড়িয়েছেন। হযরত আবু ওয়াকিদ লাইসী রা. বলেন, উমর ইবনে খাত্তাব রা. আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, নবীজী ঈদের নামাযে কী কেরাত পড়তেন? আমি বললাম, সূরা ক্বামার ও সূরা ক্বফ। (মুসলিম : ৮৯১)।

ঈদের মূলপাঠই হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত প্রাপ্তির অনুভূতি এবং ক্ষমাপ্রাপ্তির প্রত্যাশা অন্তরে জাগরূক করা রেখে ঈদগাহে হাজির হওয়া। আল্লাহর কাছে দরদী দিল নিয়ে দুআ করা৷ এরপর অনান্য সামাজিকতার পর্ব৷ শরীয়তের সীমার ভেতর থেকে সামাজিকতা রক্ষা এবং আনন্দ উপভোগের মধ্যে বিধিনিষেধ নাই৷ আল্লাহ আমাদের পাপ পঙ্কিলতামুক্ত স্বচ্ছ হৃদয় দান করুন যেন আমরা প্রকৃত ঈদ আনন্দ অনুভব করতে পারি৷ 

লেখক : শিক্ষক, মাশিকাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, দেবিদ্বার, কুমিল্লা