ছবি : সংগৃহীত

পবিত্র কাবা মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতি ও ইবাদতের প্রধান কেন্দ্র। এই ঘরের দেয়ালে বিশেষভাবে স্থাপন করা মর্যাদাপূর্ণ একটি পাথরের নাম ‘হাজরে আসওয়াদ’। আরবি ‘হাজর’ শব্দের অর্থ পাথর আর ‘আসওয়াদ’ শব্দের অর্থ কালো। ‘হাজরে আসওয়াদ’-এর অর্থ হলো কালো পাথর। 

শরিয়তের বিধান অনুযায়ী হাজিরা তাওয়াফ করার সময় এতে সরাসরি বা ইশারার মাধ্যমে চুম্বন দিয়ে থাকেন।

রাসুলের হাদিসে ‘হাজরে আসওয়াদ’

এটি একটি জান্নাতি পাথর। বিশুদ্ধ সূত্রে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হাজরে আসওয়াদ জান্নাতের পাথর। প্রথমে এটি দুধের চেয়েও অধিক সাদা ছিল। পরে মানুষের গুনাহ তাকে কালো করে দিয়েছে। (তিরমিজি, হাদিস : ৮৭৮)

‘হাজরে আসওয়াদ’ পৃথিবীতে এলো যেভাবে

জান্নাতি এই পাথরটি পৃথিবীতে কিভাবে এলো- এই ইতিহাস অনেকেরই অজানা। এ বিষয়ে তাফসিরে মাযহারীতে বর্ণিত হয়েছে, আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম জান্নাত থেকে পৃথিবীতে চলে আসার পর আল্লাহ তায়ালা ইয়াকুত মর্মর নির্মিত এবং পূর্ব ও পশ্চিমমুখী জমরূদ নির্মিত দরজাবিশিষ্ট বায়তুল মামুরকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনলেন এবং বর্তমানে কাবাঘর যেখানে অবস্থিত তার জায়গায় তা স্থাপন করলেন। 

এরপর হজরত আদম আল্লাইহিস সাল্লামকে বললেন, তুমি জান্নাতে যেভাবে এই ঘর তাওয়াফ করতে এবং এই ঘরকে ঘিরে নামাজ আদায় করতে এখানেও সেভাবে নামাজ পড়ো, তাওয়াফ করো। এসময় বায়তুল মামুরের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদকেও পৃথিবীতে নামিয়ে আনা হয়।

তাফসিরে মাযহারীর বর্ণনা অনুযায়ী, সর্বপ্রথম পৃথিবীতে নামিয়ে আনার সময় হাজরে আসওয়াদের রঙ ছিলো একেবারে সাদা এবং এটি আলোকজ্জ্বল ছিলো। তবে জাহেলি যুগে এক পাপী ও অপবিত্র নারীর স্পর্শে পাথরটি কালো হয়ে যায়।

নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনের সময় ‘হাজরে আসওয়াদ’

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, বায়তুল মামুরের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদও পৃথিবীতেই ছিলো। তবে হজরত নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনের সময় বায়তুল মামুরকে কাবাঘরের স্থান থেকে আসমানে তুলে নেওয়া হয়। 

এসময় আল্লাহ তায়ালা হাজরে আসওয়াদকে বন্যার পানি থেকে রক্ষার জন্য হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দায়িত্ব দিলেন। আল্লাহ তায়ালা হাজরে আসওয়াদকে মক্কার আবু কুবাইস পাহাড়ে সংরক্ষিত করে রাখার আদেশ দিলেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করলেন।

ইবরাহিম খলিলুল্লাহকে কাবা পুনর্নির্মাণের আদেশ

এরপর হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ কাবা পুনর্নির্মাণের আগ পর্যন্ত বায়তুল মামুরের জায়গাটি শূন্য পড়ে ছিলো। হজরত ইবারাহিম আলাইহিস সালামের ছেলে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম বাবার কাজে সাহায্য করার মতো বড় হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা তার খলিলকে কাবা ঘর পুনর্নির্মাণের আদেশ দিলেন।

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছেলে ইসামাঈলকে নিয়ে আল্লাহর নির্দেশিত জায়গায় কাবা ঘর নিমার্ণের কাজ শুরু করলেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা,-এর বর্ণনামতে, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কাবাঘর নির্মাণের সময়- হেরা, সিনাই, সিরিয়ার লুবনান, জুদী ও জায়তা- এই পাঁচটি পাহাড়ের পাথর ব্যবহার করেছিলেন।

কাবার দেয়ালে আবারও ‘হাজরে আসওয়াদ’

কাবার দেয়াল গাঁথুনির কাজ যখন হাজরে আসওয়াদের উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছলো, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছেলে ইসমাঈলকে বললেন, তাওয়াফকারীদের মন এদিকে আকৃষ্ট করতে এখানে একটি সুন্দর পাথর স্থাপন করো।

অনেক খোঁজাখুজির পর ইসমাঈল আলাইহিস সালাম একটি পাথর নিয়ে এলেন, কিন্তু পাথরটি ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পছন্দ হলো না। তিনি এর থেকে আরও সুন্দর পাথর খুঁজতে বললেন।

বাবার আদেশমতো ইসমাঈল আলাইহি সালাম বিভিন্ন পাহাড়ে গিয়ে আরও সুন্দর পাথর খুঁজতে লাগলেন। এসময় হঠাৎ আবু কুবাইস পাহাড় থেকে একটি আওয়াজ হলো- ‘হে ইসামাঈল! আপনার একটি গচ্ছিত সম্পদ আমার কাছে রয়েছে। সম্পদটি নিয়ে আমাকে দায়মুক্ত করুন’। 

আওয়াজ শুনে হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম পাহাড়ের ভেতরে গিয়ে হাজরে আসওয়াদ খুঁজে বের করলেন এবং তা কাবা শরীফের দেয়ালে রাখলেন। এভাবেই হাজরে আসওয়াদ আবার তার স্থান ফিরে পেলো। ( সুরা বাকারা আয়াত, ১২৭-১২৮ তাফসিরে মাযহারী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা, ২৫২-২৫৫)

হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের ফজিলত

হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা বরকতময়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন এ পাথর আবু কুবাইস পাহাড় থেকে বড় আকার ধারণ করে উপস্থিত হবে। তার একটি জিহ্বা ও দুইটি ঠোঁট থাকবে, (বায়তুল্লাহর জিয়ারতকারীরা) কে কোন নিয়তে তাকে চুম্বন করেছে, সে সম্পর্কে বক্তব্য দেবে।’ (ইবনে খুজায়মা : ৪/২২১; মুসতাদরাকে হাকেম : ১/৪৫৭)

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে তা স্পর্শ ও চুম্বন করতে দেখেছি।’ (মুসলিম, হাদিস : ১২৬৭)