মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তায়ালা সত্য ও শান্তির ধর্ম ইসলামের বার্তাবাহক হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি মানুষকে সত্যের বাণী শোনাতে গিয়ে বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। এক সময় যেই সমাজের লোকেরা তাঁকে নিজেদের সমাজের সবথেকে সত্যবাদী, সম্ভ্রান্ত বলে গর্ব করতো, ইসলামের পথে আহ্বানের পর তারাই তাকে অস্বীকার করে বসলো। তার যাবতীয় কাজ কর্মে বাধাপ্রদান করতে শুরু করলো।

যারা তাঁর কথায় ইসলাম গ্রহণ করতো তাদের ওপর নির্যাতন চালাতো। তাঁর চলাফেরার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। তাঁকে বিভিন্ন হুমকি ও প্রলোভন দেখাতো। কিন্তু কোনো কিছুতেই নিজের অবস্থান থেকে দূরে সরে আসেননি আল্লাহর রাসূল সা.। তিনি সত্য প্রচারে ছিলেন অবিচল। সত্য প্রচারে সাহস যুগিয়ে সবসময় তাঁর পাশে ছিলেন চাচা আবু তালেব।

ভাতিজাকে আবু তালেবের সমর্থন

আবু তালেব নিজে ইসলাম গ্রহণ না করলেও ভাতিজার কাজকে সমর্থন করে যেতেন সবসময়। তাঁর ওপর মুশরিকদের কোনো আঘাত-অত্যাচারের আশঙ্কা দেখা দিলে তিনি নিজ ক্ষমতা বলে প্রতিহত করতেন।

ভাতিজাকে রক্ষায় আবু তালেবের ভূমিকা কুরাইশ নেতাদের পছন্দ হলো না। নবী সা.-এর ইসলামের আহ্বান বন্ধ করতে তারা কয়েক দফায় আবু তালেবের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। প্রথমবার তারা আবু তালেবের কাছে গিয়ে বললো—

আবু তালেব! আপনার ভাতিজা আমাদের উপাস্যদের গালি-গালাজ করছে, আমাদের পথভ্রষ্ট, নির্বোধ বলছে। কাজেই আপনি তাঁকে বাধা দিন অথবা আমাদের সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। 

আবু তালেব মুহাম্মদ সা. ও কুরাইশদের মাঝে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করলেন। কিন্তু নবীজি সা. তাঁর সত্য প্রচার অব্যাহত রাখলেন।

কুরাইশ নেতারা আরও চটে গেল। তারা আবারো আবু তালেবের কাছে গিয়ে বললো, আপনার ভাতিজা আমাদের পূর্ব পুরুষের ধর্মকে বারবার গালিগালাজ করবে আমরা কিন্তু এটা সহ্য করবো না। এবার আপনি তাঁকে ইসলামের আহ্বান থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হলে আমরা কিন্তু তাঁর সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে নামবো। 

তাদের এসব হুমকি-ধামকির মুখে আবু তালেবের কিছুটা ভয় হলো, তিনি মুহাম্মদ সা.-কে বললেন, ভাতিজা, কুরাইশ নেতারা তোমার বিরুদ্ধে আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। তুমি অন্তত নিজের প্রতি দয়া করো। আমার ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিও না, যা আমি বহন করতে পারবো না।

চাচাকে যা বললেন মুহাম্মদ সা.

আবু তালেবের কথা শুনে নবীজির মনে হলো, কুরাইশ নেতাদের হুমকি হয়তো চাচাকে কিছুটা দুর্বল করে দিয়েছে। তিনি চাচাকে বললেন—

চাচাজান, তারা যদি আমার এক হাতে সূর্য, আরেক হাতে চাঁদ এনে দিয়ে আমাকে সত্য ও ইসলামের বাণী প্রচার করা ছেড়ে দিতে বলে তবুও আমি তা ছাড়বো না। হয়তো আমি এ কাজ পূর্ণ করবো অথবা ইসলাম প্রচার করতে করতেই আমি ধ্বংস হয়ে যাবো।

এ কথা বলে আবেগের আতিশয্যে নবীজি সা. কেঁদে ফেললেন। তা দেখে আবু তালেবের মনও কেঁদে উঠলো। তিনি ভাতিজাকে বললেন—

যাও ভাতিজা, তুমি তোমার কাজ করে যাও। আল্লাহর শপথ, আমি কখনো তোমাকে একা ছাড়বো না।

কুরাইশ নেতাদের অদ্ভুত প্রস্তুাব!

কুরাইশ নেতারা যখন দেখলো তাদের হুমকি-ধমকির মুখেও আবু তালেব কোনোভাবে নিজের ভাতিজার সমর্থন থেকে ফিরে আসবেন না, প্রয়োজনে তিনি নিজ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন।

তখন তারা অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কূট-কৌশল আঁটলো। কুরাইশ নেতা ওলীদ ইবনে মুগীরার ছেলে আম্মারকে সঙ্গে নিয়ে আবু তালেবের কাছে গেল। গিয়ে বললো—

আবু তালেব! আমরা কুরাইশ বংশের সুদর্শন যুবক আম্মারকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। আপনি তাকে নিজের সন্তানের মতো গ্রহণ করুন, সে আপনাকে সবধরনের কাজে সহায়ত করবে। এর বিপরীতে নিজের ভাতিজা মুহাম্মদকে আমাদের হাতে তুলে দিন, যে আপনার পূর্ব পুরুষদের ধর্মের বিরোধিতা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। আপনার জাতির মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করছে। আপনি আম্মারকে নিন এবং মুহাম্মদকে আমার হাতে সোপর্দ করুন। আমরা তাকে হত্যা করবো। একজনের বিনিময়ে আরেকজন দিলাম আপনাকে।

তাদের এই প্রস্তাবে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন আবু তালেব। তিনি তাদের কড়া জবাব দিলেন, বললেন—

তোমারা কীভাবে আমার সঙ্গে এমন বিনিময় চুক্তি করার সাহস করলে! কীভাবে ভাবতে পারলে যে, আমি তোমাদের ছেলেকে খাওয়াবো, লালন-পালন করবো আর নিজের ছেলেকে হত্যার জন্য তোমাদের হাতে ছেড়ে দেবো। খোদার কসম, আমি এটা কখনোই হতে দেবো না, এটা কখনোই হতে পারে না।

কুরাইশ নেতারা আবু তালেবের কাছে এসে বরাবরের মতো আবারো হতাশ হয়ে ফিরল।

(আর রাহীকুল মাখতুম)