তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিজয় ইসলামের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়। ১৪৫৩ সালের ২৯ মে মাত্র ২১ বছর বয়সে শহরটি বিজয় করেন উসমানীয় সাম্রাজের সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ (মেহমেদ দ্বিতীয়)।

মাত্র ২১ বছর বয়সে উসমানীয় সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এই বিজয় অর্জন করেন। 

৫৭২ বছর আগে এই দিনে সুলতান মুহাম্মদ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ আঘাত হানেন এবং প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের (ইস্টার্ন রোমান এম্পায়ার) অবসান ঘটান। এই বিজয়ের মাধ্যমে তিনি  উসমানীয় সাম্রাজ্যে অগ্রগতির ধারা বিস্তৃত করেন।

সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ ১৪৩২ সালের ৩০ মার্চ তৎকালীন উসমানীয় সাম্রাজের রাজধানী এদিরনে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন সুলতান মুরাদ দ্বিতীয়।  দুই বছর বয়স পর্যন্ত তিনি এদিরনে ছিলেন। ১৪৩৪ সালে তাকে আমাসিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে তার বড় ভাই আহমদ সানজাকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য তার পিতা ইসলামি ও পাশ্চাত্য শিক্ষক নিযুক্ত করেন। 

তিনি যেমন বুদ্ধিমান ছিলেন, তেমনি ছিলেন যুদ্ধপ্রিয়। তিনি পারস্য, আরবি, প্রাচীন গ্রিক ও ইতালীয় ভাষায় দক্ষ ছিলেন।

তুরস্কের ইতিহাসবিদদের মতে, সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহের লাইব্রেরিতে জ্যামিতি, ধর্ম, প্রকৌশল, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, প্রত্নতত্ত্ব, ভূগোল, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই ছিল। তিনি একজন কবি ছিলেন। শিল্পকলায় গভীর আগ্রহী ছিলেন তিনি। এমনকি রেনেসাঁ শিল্পী বেলিনিকে দিয়ে নিজের ছবি আঁকিয়েছিলেন তিনি। 

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি একটি মহান সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। হোমারের ইলিয়াড এবং টলেমির প্রাচীন মানচিত্র ছিল তার সংগ্রহে।

তিনি ছিলেন লম্বা, তার গাল ছিল গোলগাল। নাক ছিল বাঁকা। সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন তিনি। বইপড়া ছিল তার নেশা। তিনি পারস্য ও আরবিতে অনূদিত দার্শনিক রচনাগুলো পড়তেন। বিজ্ঞান ও জ্ঞান অর্জনে ব্যাপারে তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বিদ্বানকে সমর্থন দিতেন এবং তাদের গবেষণা সংরক্ষণ করতেন।

তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন অভিজ্ঞ অটোমান নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণের কাছে এবং ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বিজয়ে।

তার ইস্তাম্বুল বিজয়ের আগে অনেকবার এই শহর অবরুদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু কেউ কখনো তা জয় করতে পারেনি। মুহাম্মদ ফাতিহ জানতেন, অসম্ভবকে সম্ভব করতে হলে প্রয়োজন ব্যতিক্রমী কৌশল ও গভীর দূরদর্শিতা।

তিনি বিশাল সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন (অনেকে বলেন, সৈন্য সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছিল, আবার অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, সংখ্যাটি আরও কম ছিল)। তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নগরীর শক্তিশালী প্রাচীরের সামনে উপস্থিত হন।

তিনি স্থল ও নৌপথে শহর ঘিরে ফেলেন এবং এক অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ নেন। ৫০ দিনের বেশি সময় ধরে এই অভিযান চলে, বিশাল কামানের গুলিতে প্রাচীর ভেঙে সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করে।

১৪৫৩ সালের ২৯ মে অবশেষে শহরের পতন হয় এবং মুহাম্মদ ফাতিহ ‘বিজয়ী’ উপাধি অর্জন করেন।

মাত্র ২১ বছর বয়সেই তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের পাতায় ঠেলে দেন এবং উসামনীয় রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যে পরিণত করেন, এই সাম্রাজ্য শত শত বছর তিনটি মহাদেশে রাজত্ব করে।

ইস্তাম্বুল বিজয় ছিল তার জীবনে উল্লেখযোগ্য অর্জন, তবে তিনি পরে সার্বিয়া, মোরিয়া, ত্রাবজন (বর্তমান তুরস্কের উত্তরাঞ্চল), বসনিয়া, আলবেনিয়া এবং বিভিন্ন আনাতোলীয় অঞ্চলও জয় করেন।

১৪৮১ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এবং নিজে ২৫টি সামরিক অভিযানে অংশ নেন। তিনি ইস্তাম্বুলকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী করেন এবং সাম্রাজ্যের সীমানা দানিউব নদী থেকে কিজিলিরমাক পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।

তার জীবনের শেষ যুদ্ধ জয়ের ঘটনা ঘটে ১৪৮০ সালে ওত্রান্তো (ইতালি) বিজয়ের মাধ্যমে। তিনি তখন রোম অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু ১৪৮১ সালের ৩ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তুর্কি ইতিহাসবিদদের মধ্যে এখনও বিতর্ক রয়েছে – তিনি কি আসলেই রোম জয়ের পরিকল্পনা করছিলেন, নাকি পূর্ব দিকে সম্প্রসারণের কথা ভাবছিলেন?

তবে এটুকু নিশ্চিত, ৪৯ বছরের জীবনে অসংখ্য বিজয়ের মাধ্যমে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ। তার বিজয়গাঁথা এবং উত্তরাধিকার আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

সূত্র : টিআরটি