বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। কখনো কখনো হাসি-আনন্দে কাটে, কখনো বিপদ ও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিটি মুহূর্তই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত। কখনো কঠিন সময় গেলে তা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসেবে ধরে নিতে হবে। একে মন্দ বা খারাপ সময় ভাবা ঠিক হবে না।

জীবনের কঠিন সময়গুলো মানুষের মনোবল দৃঢ় করতে সহায়তা করে। কঠিন সময় সফলভাবে পেরিয়ে গেলে একজন মানুষ বেশ কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। যেমন—

  • শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা অর্জন।
  • আল্লাহর স্মরণ বৃদ্ধি।
  • গুনাহ ও ভুলত্রুটি থেকে পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ।
  • ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরীক্ষা।

সঠিকভাবে কঠিন সময় পার করতে পারলে তা মূলত একজন মানুষকে আল্লাহর আরও কাছাকাছি নিয়ে, তাকে সঠিক পথের দিশা দেয়।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কঠিন সময় পার করতেন যেভাবে 

পৃথিবীতে যারা সঠিকভাবে কঠিন সময় মোকাবিলা করেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম উদাহরণ হলেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। জীবনে তাকে অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি আল্লাহর ভরসা রেখে ধৈর্যধারণ করে তা পার করেছেন। 

একজন মুসলিমের জন্য মহানবী (সা.) এর জীবনের প্রতিটি ধাপ ও কাজ অনুসরণ করা জরুরি। কারণ, আমরা সাক্ষ্য দেই— আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। সুতরাং তার জীবন ও পথের অনুসরণ করা ইসলামের একটি মৌলিক অংশ।

নবীজির জীবনের কঠিন সময়

মহানবী সা. ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। এরপর ১০ বছর তিনি মক্কা এবং ১৩ বছর মদিনায় ছিলেন। তার পুরো জীবন সফলতায় পূর্ণ ছিল। তবে জীবনের ধাপে ধাপে তাকে পরীক্ষা এবং বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় দিক থেকে বহু কষ্ট সহ্য করেছেন।

তবে তিনি সবসময় আল্লাহর সাহায্য ও দিকনির্দেশনায় এই বিপদ ও কঠিন সময় পার করেছেন।

একসঙ্গে আপনজনদের হারিয়েছেন মহানবী (সা.)

মহানবী (সা.) যখন মক্কার কাফেরদের ইসলামের পথে আহ্বান করলেন, তখন তারা তাকে কষ্ট দেওয়া শুরু করলো। তার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে লাগলো, কিন্তু তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ইসলামের দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। এসময় তাকে সান্ত্বনা দিতেন প্রিয় সহধর্মীণী খাদিজা (রা.)। অভিভাবক হিসেবে তার সাহস জোগাতেন চাচা আবু তালেব। 

মহানবী (সা.) এর এই দুই প্রিয় মানুষ একই বছরে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ইন্তেকাল করেন। তাদের হারিয়ে রাসুল (সা.) শোকের সাগরে ভাসতে থাকেন। এই বছরটিকে ইসলামে ‘আমুল-হুজন’ (বিষাদের বছর) বলা হয়।

মক্কার কাফেরদের বাড়াবাড়ি...

মহানবী (সা.) এর পরম আশ্রয়স্থল প্রিয় দুইজনের ইন্তেকালের পর মক্কার কাফেররা বুঝতে পারলো মুহাম্মদ (সা.)-কে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো আর কেউ নেই। এই সুযোগে তারা রাসুল সা.-কে মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি শারীরিকভাবেও আঘাত করে।

আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন নবীজি (সা.) কাবার পাশে নামাজ পড়ছিলেন। সেখানে মক্কার সাতজন নেতা বসেছিলেন। আবু জাহল বলল : তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছো যে মুহাম্মদ যখন সিজদায় যাবে, তখন তার কাঁধে উটের নাড়িভুঁড়ি রেখে দেবে!

উপস্থিত লোকদের মধ্যে সবচেয়ে মূর্খ উকবা ইবন আবি মুয়াইত গিয়ে নবীজির পিঠে নাড়িভুঁড়ি রেখে এলো। নবীজি (সা.) তাদের কিছুই বলেননি।

মহানবী (সা.)  ছোট কন্যা ফাতিমা (রা.) খবর পেয়ে এসে তা সরিয়ে দেন এবং তাদের সবাইকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। এরপর নবীজি (সা.) মাথা তোলেন এবং আল্লাহর কাছে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ দেন।

মিথ্যা অপবাদ

ইসলামের পথে আহ্বান আগে মক্কার লোকেরা মুহাম্মদ (সা.)-কে আল-আমিন বা বিশ্বাসী বলে থাকতো। কিন্তু তিনি যখন ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন, তখন তারা তাকে মিথ্যাবাদী, জাদুকর, কবি, গণক বলে অপবাদ দেওয়া শুরু করলো।

তায়েফ সফরে পাথর দিয়ে আঘাত

মক্কার মুশরিকদের কাছে হতাশ হয়ে মহানবী (সা.) তায়েফের লোকদের ইসলামের পথে আহ্বান করতে গেলেন। কিন্তু সেখানেও হতাশ হলেন তিনি। তায়েফের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলো না, উল্টো তারা তাকে নিয়ে উপহাস করলো। শিশু ও দাসদের লেলিয়ে দিয়ে মুহাম্মদ সা.-কে পাথর দিয়ে আঘাত করলো। এতে তার শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গেল, জুতা লাল হয়ে গেল।

মহানবীকে হত্যার পরিকল্পনা

শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও মহানবী (সা.) মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করে যেতে লাগলেন। কুরাইশদের কোনো বাধা তাকে টলাতে পারলো না। মুশরিকেরা কোনোভাবে পেরে না উঠে মুহাম্মদ সা.-কে হত্যার ফন্দি আঁটে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে দেননি। তিনি রাসুল (সা.)-কে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দেন। রাসুল সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন।

মদিনার জীবনে চ্যালেঞ্জ

মক্কায় মুশরিকদের নিযার্তন বেড়ে গেলে আল্লাহর নির্দেশে রাসুল (সা.) মক্কায় হিজরত করেন। মদিনায় তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেখানেও তাকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যেমন—

  • মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র।
  • স্ত্রী আয়িশা (রা.)-কে নিয়ে কুৎসা রটনা।
  • একাধিক গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধ।
  • প্রিয় চাচা হামজা (রা.)-সহ ৭০ সাহাবির শাহাদাত।
  • খন্দকের যুদ্ধ মোকাবিলা। এই যুদ্ধে পুরো মদিনা ধ্বংসের মুখে পড়ে।
  • ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা।

প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতি পার করে তিনি বিশ্বের বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং উম্মতে মুহাম্মদকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি এই কঠিন সময়গুলো পার করেছেন মূলত আল্লাহ ওপর ভরসা রেখে এবং ধৈর্যধারণ করে। 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষ কি মনে করেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে?(সূরা আনকাবূত, আয়াত : ২)।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, 

নাকি তোমরা মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত অবস্থা আসেনি? অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল এমনকি রাসূল ও তার সংগী-সাথী ঈমানদারগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।(সূরা বাকারা, আয়াত : ২১৪)

মহানবী (সা.) এর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, বিপদ ও কঠিন সময় আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, তার জীবনের প্রতিটি কষ্ট আমাদের জন্য পথনির্দেশনা। বিপদে তার সহনশীলতা, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল, সাহসিকতা এবং সত্যের প্রতি অবিচলতা আমাদের জন্য পাথেয়।

সূত্র : অ্যাবাউট ইসলাম অবলম্বনে