আশুরা আমাদের যে শিক্ষা দেয়
আল্লাহ তাআলা যখন আসমান জমিন সৃষ্টি করেন, তখন থেকেই সময়ের হিসাব নির্ধারিত করে দিয়েছেন। বারো মাসের এই হিজরি পঞ্জিকার মাঝে তিনি চারটি মাসকে সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন। এই চারটি সম্মানিত মাস হলো রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। মহররম মাসটি শুধু সম্মানিতই নয়, এটি হিজরি নববর্ষের প্রথম মাসও। এই মাসের একটি বিশেষ দিন আশুরা ইসলামি ইতিহাসের অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও হৃদয়স্পর্শী দিন।
ঐতিহাসিক বহু ঘটনার নিরব সাক্ষী এই দিন। আল্লাহ তাআলা এই দিনেই নূহ (আ.) এর কিশতিকে জুদী পাহাড়ে স্থিত করেছিলেন, এই দিনে মুসা (আ.) -কে ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং তার শত্রুকে চূর্ণ করেছিলেন। এই দিনেই আল্লাহ তাআলা আদম (আ.) এর তওবা কবুল করেছিলেন, ইদ্রীস (আ.) কে উঁচু মর্যাদায় উত্তোলন করেছিলেন, আইউব (আ.) কে রোগমুক্ত করেছিলেন (ইবনু রজব, লাতায়িফুল মা'আরিফ)।
বিজ্ঞাপন
এসব ঘটনা আমাদের জানিয়ে দেয় আল্লাহর ওপর নির্ভর করলেই তিনি পথ করে দেন মুক্তির।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারো, আল্লাহর কিতাবে সেদিন থেকেই যেদিন তিনি আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সঠিক জীবনপথ। সুতরাং এই মাসগুলিতে নিজেদের ওপর জুলুম কোরো না। (সূরা আত-তাওবাহ: ৩৬)
বিজ্ঞাপন
হাদীস শরীফে মহানবী (সা.) বলেন: রমজানের পরে সর্বোত্তম রোজা হলো মহররম মাসে রোজা রাখা। (সহীহ মুসলিম)
আশুরা শব্দটি এসেছে আরবি আশারা শব্দ থেকে যার অর্থ দশ । মহররম মাসের দশম দিনকে বলা হয় আশুরা। এই দিনটি ইতিহাসে গভীরভাবে জড়িত অসংখ্য স্মৃতিময় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে। এদিনে ঘটেছে নবী-রাসূলদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো, এবং এই দিনেই সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ে রচিত হয়েছে শহীদের রক্তে এক মহাকাব্য।
ইতিহাসে জানা যায়
- হজরত আদম (আ.) কে এদিনে সৃষ্টি করা হয় এবং এদিনেই তাঁর তওবা কবুল করা হয়।
- হজরত নূহ (আ.) এর কিশতী জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে এই দিনে।
- হজরত ইবরাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং আগুন থেকে মুক্তি লাভ করেন এই দিনে।
- হজরত মূসা (আ.) লোহিত সাগর পার হন ও ফেরাউন তার সেনাবাহিনীসহ সাগরে ডুবে মারা যায় এই পবিত্র আশুরার দিনেই।
- হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেন এই দিনে।
- হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান, হজরত ইউসুফ (আ.) পিতার সাথে পুনরায় মিলিত হন,
- হজরত ঈসা (আ.) আসমানে উত্তোলিত হন এই সব ঘটনাও আশুরার দিনের বরকতপূর্ণ ঘটনা।
এইসব ইতিহাস শুধু চিরস্মরণীয় নয়, এগুলো এক অনন্য শিক্ষা বহন করে: সত্য ধৈর্য ও ত্যাগের মাধ্যমে জয়ী হয়, আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সহায়তা আসে তাঁর বান্দাদের জন্য যারা তার ওপর আস্থা রাখে।
কারবালার প্রান্তরে আত্মত্যাগের অমর ইতিহাস
তবে আশুরার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও বিশ্বমুসলিমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ৬১ হিজরি সালের ১০ মহররম কারবালার সেই নির্মম মর্মান্তিক ঘটনা । সেদিন দুনিয়ার ইতিহাসে লেখা হয়েছিল ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দৌহিত্র, জান্নাতের যুবকদের সরদার, ইমাম হুসাইন (রা.) পরিবার ও সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এক কঠিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত। কারবালার প্রান্তরে তাওহিদের পতাকা সমুন্নত রাখতে গিয়ে তিনি পরিবারসহ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।
ইয়াজিদের অন্যায় শাসন ও ইসলামবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে হুসাইন (রা.) বলেছিলেন: আমি অহংকার, দম্ভ বা সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য বের হইনি। আমি বের হয়েছি আমার নানা মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের সংস্কারের জন্য। আমি চাই ভালোকে আদেশ দিতে এবং মন্দ থেকে নিষেধ করতে। (ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক)
৭২ জন সত্যপথিক কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। তাঁদের রক্তের প্রতিটি ফোঁটা প্রমাণ করে, ন্যায়কে রক্ত দিয়ে রক্ষা করতে হয়, তবু অন্যায়ের সাথে আপস চলে না।
আশুরা আমাদের শেখায়
আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা ও নির্ভরতা কেমন হতে হয়।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস কাকে বলে।
সবর, তাওবা, তাকওয়া ও আত্মত্যাগের প্রকৃত অর্থ কী।
পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টিই আসল সফলতা।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিন রোজা রাখতেন এবং বলেছেন: আমি আশাকরি আল্লাহ এই (আশুরার) দিনের রোজার দ্বারা গত বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। (সহীহ মুসলিম)
মহররমের শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়ন করার মানে হলো নিজেকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, ও আত্মাকে বিশুদ্ধ করা। এই পবিত্র দিনকে কেন্দ্র করে যেন আমরা ইতিহাসকে মনে রাখি, হৃদয়ে ধারণ করি, এবং সে অনুযায়ী জীবন গঠনের সংকল্প করি।
আল্লাহ আমাদের আশুরার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করার তাওফিক দিন, হুসাইন (রা.) এর মত সাহস, তাওহীদের মতো বিশ্বাস, আর নূহ (আ.) এর মতো ধৈর্য দান করুন। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিন হয়ে উঠুক আশুরার শিক্ষায় আলোকিত। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুস সুন্নাহ মাদরাসা মাতুয়াইল, ডেমরা, ঢাকাি
এনটি/এমআইকে