মহান যোদ্ধা হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী
ছবি : সংগৃহীত
ঐতিহাসিক ফরায়েজি আন্দোলনের মহানায়ক হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৮৪০ সালের ২৮ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন তিনি। ফরিদপুরের সামাইলে তাকে দাফন করা হয়।
হাজী শরীয়তুল্লাহ একদিকে রাজনৈতিকভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। আর অপরদিকে সামাজিকভাবে তিনি অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ও নীল কুঠিয়ালদের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। সেই সাথে মুসলমানদের মধ্যে শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার দূর করার জন্য সংস্কারের এক মহা বিপ্লবের ধারাও বেগবান রাখেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
শরীয়তুল্লাহর সংস্কার আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মীয়। কিন্তু সমাজের অন্যান্য বেশ কিছু দিকও এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। ইসলামি পুনর্জাগরণের সমর্থক, একজন সমাজ সংস্কারক এবং একজন জনপ্রিয় কৃষকনেতা হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এ সময়ে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং হিন্দু জমিদারদের কুশাসন, শোষণ ও অত্যাচারে বাংলার তফসিলি হিন্দু- মুসলিম জনগণ অতিষ্ট ছিল।
পলাশীর বিপর্যয়ের পর একদিকে ব্রিটিশ এবং অপরদিকে অত্যাচারী বর্ণহিন্দু জমিদার মহাজনদের উপর্যুপরি অত্যাচার-নিষ্পেষণে মুসলমানরা অনন্যোপায় হয়ে মাথানত করে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিল। তখন শরীয়তুল্লাহর আহ্বানে নিপীড়িত তফসিলি হিন্দু-মুসলমান দলে দলে তার কাছে এসে জমায়েত হতে শুরু করে এবং ব্রিটিশ ও বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করে ।
বিজ্ঞাপন
হাজী শরীয়াতুল্লাহর আন্দোলনে বর্ণহিন্দুস্বার্থে চরম আঘাত লেগেছিল বলে তারা ইংরেজ শাসকদের সহায়তায় তাঁকে দমন করতে বিপুল শক্তি প্রয়োগ করে। তৎকালীন বর্ণহিন্দু সমাজের মনোভাব হাজী শরীয়তুল্লাহর প্রতি কতখানি বিদ্বেষাত্মক ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৩৭ সালের ২২শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণে’ প্রকাশিত একখানি পত্রে। পত্রটি নিম্নে উদ্ধৃত হলো—
ইদানীং জেলা ফরিদপুরের অন্তঃপতি শিবচর থানার সরহদ্দে বাহাদুরপুর গ্রামে সরিতুল্লা নামক একজন বাদশাহী লওনেচ্ছুক হইয়া নূন্যাধিক বার হাজার জোলা ও মুসলমান দলবদ্ধ করিয়া নতুন এক শরা জারি করিয়া নিজ মতাবলম্বী লোকদিগের মুখে দাড়ি, কাছা খোলা, কটিদেশে ধর্মের রজ্জুভৈল করিয়া তৎচতুর্দিগস্থ হিন্দুদিগের বাটি চড়াও হইয়া দেবদেবী পূজার প্রতি অশেষ প্রকার আঘাত জন্মাইতেছে –এই জিলা ঢাকার অন্তঃপাতি মতলবগঞ্জ থানার রাজনগর নিবাসী দেওয়ান মৃত্যুঞ্জয় রায়ের স্থাপিত দ্বাদশ শিবলিঙ্গ ভাঙ্গিয়া নদীতে বিসর্জন দিয়াছে এবং ঐ থানার সরহদ্দে পোড়াগাছা গ্রামে একজন ভদ্রলোকের বাটিতে রাত্রিযোগে চড়াও হইয়া সর্বস্ব হরণ করিয়া তাহার গৃহে অগ্নি দিয়া অবশিষ্ট যে ছিল ভস্মরাশি করিলে এজন যবন মৃত হইয়া ঢাকায় দওরায় অর্পিত হইয়াছে।
আর শ্রুত হওয়া গেল, সরিতুল্লার দলভুক্ত দুষ্ট যবনেরা ঐ ফরিদপুরের অন্তঃপাতি পাটকান্দা গ্রামের বাবু তরিনী চরণ মজুমদারের প্রতি নানা প্রকার দৌরাত্ম্য অর্থাৎ তাহার বাটিতে দেব-দেবী পূজায় আঘাত জন্মাইয়া গোহত্যা ইত্যাদি কুকর্ম উপস্থিত করিলে মজুমদার বাবু যবনদিগের সহিত সম্মুখ যুদ্ধ অনুমতি বোধ করিয়া ঐ সকল দৌরাত্ম্য ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুজুরে জ্ঞাপন করিলে ঐ সাহেব বিচারপূর্বক কয়েকজন যবনকে কারাগারে বন্ধ করিয়াছেন এবং এ বিষয়ে বিলক্ষণ অনুসন্ধান করিতেছেন। হে সম্পাদক মহাশয়, দুষ্ট যবনেরা মফঃস্বলে এ সকল অত্যাচার ও দৌরাত্ম্যে ক্ষান্ত না হইয়া বরং বিচারগৃহে আক্রমণ করিতে প্রবৃত্ত হইল। শ্রুত হওয়া গেল, ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুজরে জে সকল আমলা ও মোক্তার –কারেরা নিযুক্ত আছে, তাহারা সকলেই সরিতুল্লা যবনের মতাবলম্বী তাহাদের রীতি এই যেদি কাহার নামে মিথ্যা অভিযোগ করিতে হয়, তবে কেহ ফরিয়াদী কেহ বা সাক্ষী হইয়া মোকদ্দমা উপস্থিত করে সুতরাং ১২০০০ লোক দলবদ্ধ। ইহাতে ফরিয়াদীর সাক্ষীর ত্রুটি কি আছেৃ আমি বোধ করি, সরিতুল্লা যবন যে প্রকার দলবদ্ধ হইয়া উত্তর উত্তর হইতেছে অল্পদিনের মধ্যে হিন্দুধর্ম লোপ পাইয়া অকালে প্রলয় হইবেক। সরিতুল্লার চোটপাটের শত অংশের এক অংশ তিতুমীর করিয়ছিল না।