‘অস্ট্রেলিয়ার সন্তানেরা, তার প্রতি অনুগত ও সত্য হও/ পত-পত ওড়াও সাউদার্ন ক্রসের পতাকা’ হেনরি লওসনের ‘ফ্ল্যাগ অফ দ্য সাউদার্ন ক্রস’ এর পঙক্তিগুলোকে যেন জীবনের ধ্রুবতারা করে নিয়েছিলেন রডনি মার্শ। শুধু অস্ট্রেলিয়াই অবশ্য নয়, ক্রিকেটের প্রতিও তিনি সমানভাবে ছিলেন অনুগত ও সত্য। অস্ট্রেলিয়া তার সেই অনুগত সন্তানকে হারিয়ে বসেছে আজ। 

হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন কিছু দিন আগে। এরপর গেল সপ্তাহে জানা যায়, কোমায় চলে গেছেন তিনি, আছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। জীবনে বহু লড়াইয়ে জিতলেও মার্শ এবার আর পারলেন না। ৭৪ বছর বয়সে ধরার মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমালেন পরপারে।

অনূর্ধ্ব ১৬ ক্রিকেট দলে আর্মাডেলের ‘দাদাভাইদের’ সঙ্গে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে অভিষেক ‘পুঁচকে’ রডনির, হাতে উঠল উইকেটরক্ষকের গ্লাভসও। সময় গড়াতে গড়াতে ক্রিকেটীয় সমঝটাও বাড়ল পাল্লা দিয়ে, ১৩ বছর বয়সে পেলেন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া স্কুলবয় দলের অধিনায়কত্ব। 

রাজ্য দলের অভিষেকটা ছিল চোখে পড়ার মতো। ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ আর স্যার গারফিল্ড সোবার্সদের তোপ সামলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচেই খেলে বসেছিলেন ১০৪ রানের এক ইনিংস। এরপর এমন আরও কিছু ইনিংস খেলে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের নজরেই চলে এলেন রডনি। তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচক ১৯৭০-৭১ মৌসুমে তাকে ডেকে বসলেন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলে, তাও আবার ‘বিশেষজ্ঞ’ উইকেটরক্ষক হিসেবেই।

এ পর্যন্ত রডনি মোটেও ‘বিশেষজ্ঞ’ উইকেটরক্ষক ছিলেন না। তার পরিচয়টা ছিল আগে ব্যাটার, পরে উইকেটরক্ষক। আর এর আগ পর্যন্ত ক্রিকেটে উইকেটরক্ষকের সংজ্ঞা ছিল, যিনি উইকেটরক্ষণটা ভালোভাবে করবেন, ব্যাটিংটা তেমন ভালো না হলেও চলে। ব্র্যাডম্যানের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সে সময় সমালোচনাও হয়েছে বেশ। তবে সেই সুযোগটা রডনি কাজে লাগিয়েছিলেন এমনভাবে, যা পরে ক্রিকেটে উইকেটরক্ষকের সংজ্ঞাই দিয়েছিল বদলে। প্রকৃত ‘বিশেষজ্ঞ’ ব্যাটার-উইকেটরক্ষক-অলরাউন্ডার হয়ে উঠেছিলেন তিনি, যার পথ ধরেই পরে ক্রিকেটকে রাঙিয়েছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, কুমার সাঙ্গাকারা, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা।

শুরুর দিকে কিছু ভুলচুক করেছেন, তবে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আর তীব্র নিবেদন দিয়ে পরে ‘অ্যাকিলিস হিল’টাকেও শক্তির জায়গা বানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। দলের প্রতি ভালোবাসা আর নিবেদনের বহিঃপ্রকাশটা তিনি প্রথম টেস্ট সিরিজেই দেখিয়েছিলেন। অপরাজিত ৯২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, গড়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান উইকেটরক্ষকের তৎকালীন সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। তবে সেঞ্চুরিটাও হয়ে যেত, যদি না অধিনায়ক বিল লরি তাকে সেঞ্চুরি থেকে আট রান দূরে রেখে ইনিংস ঘোষণা করে দিতেন। 

অধিনায়কের সে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করায় তখন একে দেখা হচ্ছিল দলের প্রতি নিবেদনের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে, যা তাকে শিগগিরই অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুম আর ভক্তদের ভালোবাসা পাইয়ে দিয়েছিল। যা দলে তার জায়গাটাও পোক্ত করে দিয়েছিল অনেকটা, আর বাকিটা ইতিহাস।

সেই সিরিজের শেষ টেস্টে অভিষিক্ত ডেনিস লিলির বলে প্রথম ক্যাচটা নিয়েছিলেন তিনি। এরপর তারই বলে আরও ৯৫টা ক্যাচ নিয়েছেন, একই বোলারের বলে একই ফিল্ডার বা উইকেটরক্ষকের এর চেয়ে বেশি ক্যাচ নেওয়ার কীর্তি ক্রিকেটে নেই আর একটা। তার যে উইকেটরক্ষণের জন্য কথা শুনতে হয়েছিল ব্র্যাডম্যানকে, সেই উইকেটরক্ষণ দিয়েই কীর্তি গড়ে বসেছিলেন অভিষেকের মৌসুমেই। ১৯৭২ অ্যাশেজটা তিনি শেষ করেছিলেন ২৩টা ক্যাচ নিয়ে, যা এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি ক্যাচের নজির হয়ে গিয়েছিল।

ব্যাটও চলেছে সমানতালেই। সেই সিরিজেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯১, পাকিস্তানের বিপক্ষে ১১৩ করে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান উইকেটরক্ষক হিসেবে সেঞ্চুরি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩২, ১১০। অবশ্য সোবার্সের উইন্ডিজকে পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে যার রাজ্য ক্রিকেটে অভিষেক, তার তো এমন পারফর্ম্যান্স হওয়ারই কথা!

যে হেনরি লওসনের ‘ফ্ল্যাগ অফ দ্য সাদার্ন ক্রস’কে জীবনের ধ্রুবতারা করে নিয়েছিলেন রডনি, সেটাকে পরে অস্ট্রেলিয়া দলেও টেনে এনেছিলেন তিনি, আক্ষরিক অর্থেই। অবশ্য তাতে কিছুটা স্বকীয়তাও মিশে ছিল। সে কবিতাটাই পরে হয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার জয় উদযাপনের গান।

ক্রিকেটের প্রতি, ক্রিকেটের রীতিনীতির প্রতিও যে সমান নিবেদিত ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে বেশ কিছু ঘটনায়। ১৯৭৭ সালের অ্যাশের কথাই ধরুন। সে বছর অ্যাশেজের শতবর্ষপূর্তির ম্যাচে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড তাড়া করছিল ৪৬৬ রানের বিশাল এক লক্ষ্য। সেই ইনিংসেই অস্ট্রেলিয়ার জয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান ডেরেক র‍্যান্ডেল। তবে ইংলিশরা যখন ৪ উইকেট হারিয়ে ৩০০ তুলেছে, আর র‍্যান্ডেল ১৬১ রানে, তখনই তিনি উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন রডনি মার্শকে। আম্পায়ার টিম ব্রুকসেরও মনে হলো আউট। তখনই রডনি গিয়ে অজি অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেলের কাছে বললেন, ‘বলটা তো আমি হাতে ঠিকঠাক জমাতে পারিনি’! যার ফলে র‍্যান্ডেলকে ডাকা হয় আবার, যদিও তিনি পরে আউট হন ১৭৪ রানেই। তবে সে ঘটনাটা রডনিকে নতুন এক পরিচয় দিয়ে গিয়েছিল সেদিন।

বছর চারেক পর যখন ‘আন্ডারআর্ম বল’ করে সমালোচিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, তার ঠিক আগে পুরো অস্ট্রেলিয়া দলের বিপরীতে গিয়ে উইকেটরক্ষক রডনি গিয়ে গ্রেগ চ্যাপেলকে বলেছিলেন, ‘এমনটা করো না!’ এ থেকে অন্তত ক্রিকেটের প্রতি মার্শের ভালোবাসা-নিবেদন নিয়ে বেশ একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানার আগে রডনি বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তাড়া করার জন্য কিছু রেখে যাচ্ছি আমি।’ ৩৫৫ টেস্ট ডিসমিসাল ‘তাড়া করার মতো কিছুই’ বটে। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন তিনি। 

শুধু কি তাই, রডনি এর মাঝে করেছিলেন ধারাভাষ্য দেওয়ার কাজও। খেলোয়াড়, ধারাভাষ্যকার, নির্বাচক, কোচ হিসেবে প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি ছিলেন ক্রিকেটে, উড়িয়েছেন অস্ট্রেলিয়া পতাকা, ক্রিকেটের পতাকা। এমন এক কিংবদন্তিকেই আজ হারাল অস্ট্রেলিয়া, ক্রিকেটও বৈকি! 

এনইউ