স্থগিত হওয়া জাতীয় ক্রিকেট লিগের প্রসঙ্গ তুলতেই ফোনের ওপাশ থেকে এই টুর্নামেন্টে খেলা এক ক্রিকেটার একরাশ হতাশা প্রকাশ করে বললেন, ‘কি বলবো আর! কি ই-বা বলার থাকে বলেন? আমরা তো সব টুর্নামেন্টে সুযোগ পাই না। নিয়মিত ঘরোয়া আসরগুলোতে খেলি, সেগুলো যদি বছরের পর বছর না হয় তাহলে আমরা চলবো কিভাবে! জানি না ভাগ্যে কী আছে।’

করোনাভাইরাসের শঙ্কা মাথায় নিয়ে ২০২০ সালের ১৫ মার্চ ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ মাঠে গড়ায়। তবে এক রাউন্ড পরই বন্ধ হয়ে যায় সেটি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আপাতত স্থগিত করা হচ্ছে ডিপিএলের দ্বিতীয় রাউন্ড। এরপর সে বছরের ১৯ মার্চ টুর্নামেন্টের ৫ রাউন্ড স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয় বিসিবি। একই দিন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন গণমাধ্যমকে জানান, শুধু ডিপিএলই নয়, পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল প্রকার প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট বন্ধ থাকবে। 

এরপর ঘরবন্দি জীবন কাটে ক্রিকেটারদের। প্রায় ৭ মাস পর গত বছরের অক্টোবরে শুরু হয় বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ। এরপর মাঠে গড়ায় বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ নামের আরও একটি টুর্নামেন্ট। তবে সেখানে খেলার সুযোগ মেলেনি জাতীয় দলের ভাবনার বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের, যারা শুধুমাত্র ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেন।

প্রায় এক বছর পর চলতি মাসে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট ফেরায় বিসিবি। শুরু হয় জাতীয় ক্রিকেট লিগের লড়াই। তবে এই টুর্নামেন্ট দুই রাউন্ড চলার পর দেশে করোনার প্রকোপ আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। বিপদ এড়াতে আবারও লিগ স্থগিতের পথে হাঁটে ক্রিকেট বোর্ড। যদিও বিসিবির তরফ থেকে বলা হচ্ছে, সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে খেলা। তবে দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সে বার্তা দিচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এনসিএলের ২২তম আসরের বাকি চার রাউন্ড কবে শুরু হবে তা নিয়ে আছে শঙ্কা।

এক বছর অন্ধকারে কাটিয়ে আবার সেই বিভীষিকাময় দিনে ফিরতে চান না ক্রিকেটাররা। এনসিএলের দল খুলনা বিভাগের অধিনায়ক কাজী নুরুল হাসান সোহান বলেন, এবার পূর্বের মতো পরিস্থিতি হলে সেটি গতবারের থেকে ভয়াবহ হবে।

ঢাকা পোস্টকে সোহান বলেন, ‘খেলা তো অনেকদিন পর শুরু হলো। আমরা যারা জাতীয় দলের আশেপাশে ছিলাম তারা কয়েকটা টুর্নামেন্ট খেলতে পারছি, অনেক ভাগ্যবান বলতে হবে। তবে আমরা ছাড়াও বাইরে অনেক খেলোয়াড় আছে। আমার কাছে মনে হয় একশ থেকে দেড়শ খেলোয়াড় আছে যারা জাতীয় লিগ বা প্রিমিয়ার লিগের ওপর নির্ভর করে থাকে। তারাও অপেক্ষায় ছিল যে অনেকদিন পর খেলাটা শুরু হচ্ছে। খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই খুব হতাশ।’

এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান আরও যোগ করেন, ‘আমরা প্রায় এক বছর পর খেলা শুরু করলাম। যখন খেলা শুরু হলো, তখন সবাই একটা জায়গায় থিতু হওয়ার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছিল। আপনি এতদিন পর একটা চার দিনের খেলছেন বা যেকোনো ধরনের ক্রিকেট খেলেন না কেন, এতদিন পর ফিরে মানিয়ে নেওয়া খুবই কষ্টকর। আমার কাছে মনে হয় এনসিএলের প্রথম দুই রাউন্ড হয়েছে, সেখানে সবাই চাচ্ছিল নিজের পারফরম্যান্সটা ভালো করার এবং এই জিনিসগুলো সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব মানিয়ে নেওয়া যায়। এটা আবার গ্যাপ তৈরি হচ্ছে। আসলে আমাদের তো করার কিছু নেই।’

জাতীয় স্বার্থে খেলা বন্ধ হওয়ায় সেটিকে ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছেন সিলেট বিভাগীয় দলের হেড কোচ রাজিন সালেহ। তবে বিসিবিকে ক্রিকেটারদের দিকগুলোও দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। এজন্য ইংল্যান্ডের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির উদাহরণ টানেন জাতীয় দলের সাবেক এই ক্রিকেটার।

রাজিন বলেন, ‘দেশের যে পরিস্থিতি তাতে ক্রিকেট বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি মনে করি ভালো কিছু চিন্তাভাবনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপরও আমি বলব যে খেলাটা যদি চালানো যেত তাহলে ভালো হতো। আপনি দেখেন ইংল্যান্ডের মতো দেশে কিন্তু মৃত্যুর হার অনেক বেশি, তবুও সেখানে খেলা বন্ধ হয়নি। তবে এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত ইতিবাচকভাবে নেওয়া উচিত। যদিও ‌ক্রিকেটারদের জন্য অনেক কষ্টদায়ক হবে।’

করোনার জন্য প্রায় এক বছর ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়তে হয়েছে দেশের অধিকাংশ ক্রিকেটারদের। বিশেষ করে যারা ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ বা জাতীয় লিগের মতো টুর্নামেন্টগুলো খেলে রুটি-রুজির যোগান দেন। এই টাকা দিয়ে নিজেদের পরিবার চালান। এবারও লম্বা সময় ধরে লিগ বন্ধ থাকলে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটা সহজ হবে না। সঙ্গে আগামী মে মাস নতুন করে শুরু হতে যাওয়া ডিপিএল আবার স্থগিত হলে সেটি আরও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।

রাজিন সালেহ বলেন, ‘প্রায় এক বছরের মতো হয়ে গেছে আমাদের ঘরোয়া লিগগুলো বন্ধ ছিল। এক বছর পর আবার যদি খেলা বন্ধ হয় তাহলে রুটিরুজির যে ব্যাপার, সেটি জোগান দেওয়া অনেক কষ্টকর হয়ে যাবে ক্রিকেটারদের জন্য। আমি জানি না শেষপর্যন্ত কি হবে, তবে আগের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে ক্রিকেটারদের ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে না। আমি এমন অনেকের কথা বলতে পারি, যারা শুধুমাত্র ঢাকা লিগ খেলে পরিবার চালায়। এদের কি হবে ভাবতেও পারছি না।’

সোহানের ভাষায়, ‘আমরা হয়তো কিছু ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু একশো থেকে দেড়শ ক্রিকেটার আছে এখানে, যারা পুরোপুরি নির্ভর করে ঢাকা লিগ, জাতীয় লিগের মতো টুর্নামেন্টগুলোর ওপরে। এটি অর্থনৈতিকভাবে চিন্তার বিষয়। শুধুমাত্র তাদের জন্য নয়, আমরা যারা আছি তারাও এটি নিয়ে চিন্তিত। কারণ এক বছর আমরা কোনরকম পার হয়ে গেছি, কিন্তু যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের হিমশিম খেতে হবে।’

খেলা বন্ধ হলে এর সঙ্গে শুধু অর্থনৈতিক বিষয়টিই কি জড়িত? এর আগে সাধারণ ছুটির সময় বোর্ডের পরামর্শে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি ছিলেন ক্রিকেটাররা। এতে মানসিক অবসাদে ভুগেছেন অনেকেই। সঙ্গে স্কিল আর ফিটনেস ঠিক রাখতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের। চ্যালেঞ্জ আছে আরও। যারা জাতীয় দলের আশেপাশে আছেন বা কোন কারণে দল থেকে ছিটকে পড়েছেন, তাদের ফেরার লড়াইও কঠিন হচ্ছে দিনকে দিন। এনসিএল ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলেন নুরুল হাসান সোহান, নাজমুল ইসলাম অপুদের মতো ক্রিকেটাররা। আবার দীর্ঘদিন ক্রিকেট বন্ধ থাকলে তাদের আত্মবিশ্বাসও তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি গায়ে চাপান সোহান। তাকে বর্তমানে বাংলাদেশের সেরা উইকেটকিপার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে ২০১৮ সালের পর জাতীয় দলের হয়ে খেলা হয়নি সোহানের। কিছুদিন আগে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের প্রাথমিক স্কোয়াডে ডাক পেয়েছিলেন বটে। কিন্তু মূল একাদশে সুযোগ মেলেনি। এবার এনসিএলকে পাখির চোখ করেছিলেন সোহান। তবে দুই রাউন্ড এই টুর্নামেন্ট স্থগিত হওয়ায় হতাশ তিনি।

২০১৮ সালে অভিষেক ক্যাপ মাথায় তোলেন নাজমুল ইসলাম অপু। ঘরোয়া ক্রিকেটে বাঁহাতি স্পিনে ভেলকি দেখিয়ে টাইগার শিবিরে ডাক পান তিনি। তবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটাকে বড় করার সুযোগ মিলছে না। ১৩টি টি-টোয়েন্টি সঙ্গে পাঁচটি ওয়ানডে ও একটি টেস্ট ম্যাচে থমকে আছে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। 

২০১৮ সালেই শেষবার বাংলাদেশের দলের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন। চলতি বছর ভারতের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হওয়ার কথা চূড়ান্ত। সেখানে সুযোগ করে নেওয়ার জন্য এনসিএলের ২২তম আসরে ভালো কিছু করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন অপু। ঢাকা বিভাগের হয়ে লিগের প্রথম ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার পান তিনি। কিন্তু দুই রাউন্ড পরেই বন্ধ হয়ে যায় লিগ। এতে ফেরার স্বপ্নে মরিচা পড়তে শুরু করেছে।

আপু জানালেন, ‘এবার এনসিলে আমার প্রথম ম্যাচে খুব ভালো শুরু পেয়েছিলাম। ১০ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হই। ভালো টাচে ছিলাম। গতবার করোনার সময় ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছি। তো সবমিলিয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। তবে ভাগ্য খারাপ বলতে হবে। এনসিএলটা শুরু হয়েও আবার স্থগিত হয়ে গেল। আশা ছিল টুর্নামেন্টগুলো নিয়মিত হলে আবার হয়তো দলে ফিরতে পারতাম, যে রকম ফ্লোতে ছিলাম। স্থগিত হওয়ায় খুব খারাপ লাগছে যে বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।’

টিআইএস/এমএইচ