অধারাবাহিক ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাটিং বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পুরোনো রোগ। সেই রোগ সারানোর লক্ষ্যে বড় প্রত্যাশা নিয়ে মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে বাংলাদেশ দলের কোচ করা হয়েছিল গত বছর। কিন্তু ফিল সিমন্স-মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জুটি এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে ব্যর্থ। তাদের অধীনে নিজেদের প্রিয় ফরম্যাটের মেরিটই যেন বুঝতে পারছেন না বাংলাদেশি ব্যাটাররা। ক্রিকেটারদের বেসিক আর কমনসেন্স নিয়ে নাকি কাজ করছেন সালাউদ্দিন। সেই কমন সেন্সেরই যেন বড্ড অভাব!

গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষে ডেভিড হেম্প দায়িত্ব ছাড়ার পর নতুন করে সালাউদ্দিনকে ব্যাটিং কোচ করা হয়। বছরের শেষ নাগাদ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে শুরু হয় সালাউদ্দিনের দায়িত্বভার। পরবর্তীতে তার আমলে এখন পর্যন্ত ১০টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে টাইগাররা। যার মধ্যে তারা ৯টিতেই হেরেছে।

পুরো সময়ে সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ব্যাটারদের ব্যর্থতা। ১০ ইনিংসের মধ্যে ৬ ম্যাচেই ২৫০ রান পেরোতে পারেনি শান্ত-মিরাজরা। এ ছাড়া ২০০–এর নিচে অলআউট হয়েছে দু’বার, মোটে একবার তারা ৩০০ পেরিয়েছে। ব্যাটারদের ধারাবাহিকতা নেই, এমনকি দিনের পর দিন একইভাবে উইকেট বিলিয়ে দেওয়ায় কোনো জবাবদিহিতা আছে কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে।

ঘরোয়া ক্রিকেটের জনপ্রিয় ও নামকরা কোচ সালাউদ্দিন অধ্যায় শুরুর আগে ক্রিকেটসংশ্লিষ্টদের মাঝে প্রত্যাশার পারদ ছিল আকাশসম। কারণ তার অধীনে ঘরোয়া ক্রিকেটের দলগুলো ট্রফি জিতে আসছে। সেই কোচ জাতীয় দলে যুক্ত হওয়ার পর ব্যাটারদের খেলার ধরন ও মানসিকতা বদলে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। পাশাপাশি ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করতে পারেন ব্যাটাররা! কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই প্রত্যাশার বেলুনটা ধীরে ধীরে মিইয়ে যাচ্ছে।

প্রধান কোচ ফিল সিমন্স ও সালাউদ্দিনের জুটি এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ফরম্যাটে কোনো ইতিবাচক বার্তা দিতে পারেনি। নিজেদের সবচেয়ে পছন্দের ফরম্যাটে বাংলাদেশ দল যেন হারিয়ে ফেলেছে আত্মবিশ্বাস, কৌশল আর স্বাভাবিক ক্রিকেটবোধ। যদিও দলের ভেতর থেকে শোনা যায়, সালাউদ্দিন খেলোয়াড়দের নিয়ে বেসিকসহ সব ধরনের কাজ করছেন বেশ জোরেশোরে। এখন প্রশ্ন উঠেছে– এই ‘বেসিক শেখানো’র ভিড়ে রান করার শিক্ষাটাই কি হারিয়ে যাচ্ছে? ব্যাটাররা যেন ভুলে যাচ্ছেন, ম্যাচ জিততে হলে কথা নয়, রানটাই আসল মুদ্রা।

সাম্প্রতিক সময়ের টি-টোয়েন্টি সিরিজগুলোয় ভালো করলেও, ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দলীয় ব্যর্থতা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। পরিকল্পনায় ঘাটতি, ব্যাটিং অর্ডারে হুটহাট পরিবর্তন আর শট নির্বাচনে দায়সারা মনোভাব। সব মিলিয়ে প্রিয় ফরম্যাটেই বাংলাদেশ যেন নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। সমর্থকদের আক্ষেপ– প্রত্যাশা ছিল বদলে দেবেন কোচ, কিন্তু মাঠে সেই আগের গল্পেরই দেখা মিলছে। সালাউদ্দিন কবে দেখাবেন প্রতিশ্রুত সেই রূপ– সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। জাকের আলি অনিকের মতো ব্যাটাররা নিয়মিত ব্যর্থ হলেও নিয়মিত একাদশে জায়গা পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সালাউদ্দিনের বড় ভূমিকা দেখছেন অনেকেই। 

জাতীয় দলের সাবেক প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু অবশ্য ভুল শুধরে এগিয়ে যাওয়ার কথাই বলছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন কিন্তু টি-টোয়েন্টি চক্র থেকে বের হতে না পারলে সমস্যা। টি-টোয়েন্টিকে যদি আমরা বেশি অগ্রাধিকার দিই, তাহলে কিন্তু অন্য ফরম্যাটে খেলা কঠিন হয়ে যাবে। অন্যান্য দেশগুলো নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে। আমাদের কম সংখ্যক খেলোয়াড়, যাদের সবাই আবার সব ফরম্যাটে খেলে। সময় এসেছে এটাকে একটা সিস্টেমের মধ্যে আনার, একইসঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।’

এজন্য অবশ্য কেবল ব্যাটিং কোচ সালাউদ্দিনকে দোষ দিতেও নারাজ নান্নু, ‘আমি ওভাবে চিন্তা করছি না। দল হিসেবে ভালো খেলছি না আমরা। এই ফরম্যাটে সেভাবে চিন্তা করে আগাতে হবে, সামনে কি করণীয় তা নিয়ে পজিটিভ চিন্তা করতে হবে। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। পুরো দলটাকেই দেখতে হবে, এখানে আরও অনেক কোচ আছেন। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ আছে, তার আগে ভুলগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।’

একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞ ব্যাটিং কোচ নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন নান্নু, ‘ব্যাটিং নিয়ে তো আমরা অনেকদিন ধরে সমস্যায় ভুগছি। ভালো বিশেষজ্ঞ ব্যাটিং কোচ দরকার আসলে। শুধু জাতীয় দল না, বয়সভিত্তিক দল বা এইচপি ক্রিকেট সব জায়গায় এমন কোচ দরকার। আমাদের এসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এগোতে হবে।’

জাতীয় দলের সাবেক দুই নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও হাবিবুল বাশার

সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন অবশ্য জাতীয় দলের ব্যাটিংকে দুই শব্দে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘ভেরি ভেরি আন-প্রফেশনাল এবং প্যাথেটিক ব্যাটিং। দুই শব্দে আমি ব্যাখ্যা করলাম। আমাদের ব্যাটিং আসলে প্রফেশনাল মনে হয়নি। কমিটেড ব্যাটিং মনে হয়নি, চ্যালেঞ্জিং উইকেট কিন্তু আমাদের আরও ভালো খেলা উচিত। প্রথম ম্যাচ এবং গতকাল দুই ম্যাচই আসলে খারাপ ব্যাটিং, পেশাদার নয় কোনোভাবেই।’

ক্রিকেটারদের জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা প্রসঙ্গে বাশার বলেন, ‘জবাবদিহিতা কিন্তু সবসময় থাকে, এটা আলাদাভাবে করা যায় না। জোর করে আসলে জবাবদিহিতা করা যায় না, এটাও প্লেয়ারদের মধ্যে দিয়ে আসতে হবে।’ 

এদিকে, ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স কিংবা নতুন ব্যাটিং কোচ নিয়োগের বিষয়ে বেশ কয়েকজন বোর্ড পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এসএইচ/এএইচএস