অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি কেমন, দেশে ফিরে জানালেন তালহা
জাতীয় দলে নিজের ক্যারিয়ার লম্বা না হলেও কোচিংয়ে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন সাবেক ক্রিকেটার তালহা জুবায়ের। নারী দল, অনূর্ধ্ব-১৯, বাংলাদেশ টাইগার্স এবং ‘এ’ দলে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে বিপিএলেও তালহার কোচিং প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার কারণেই ডাক পেয়েছিলেন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের।
প্রায় এক মাস ধরে পার্থে ক্রিকেট কোচিং করিয়েছেন তালহা জুবায়ের। এই সময়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছেন। দেশে ফিরে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলোচনায় সেই গল্প বললেন তালহা। তার মতে, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সংস্কৃতির মূল ভিত্তি ক্লাব ক্রিকেট। এই ক্লাবগুলো হয় স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। খেলোয়াড়রা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে খেলাধুলা চালিয়ে যান। ক্লাব তাদের কোনো দায়ভার বহন করে না। উল্টো ক্লাবে খেলার সুযোগ দেওয়ার জন্য খেলোয়াড়রা তাদের ফি দেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বড় বড় ক্রিকেটার উঠে আসে বলে দাবি এই কোচের।
বিজ্ঞাপন
অস্ট্রেলিয়ার ক্লাব ক্রিকেটের কাঠামো নিয়ে তালহা জুবায়ের বলেন, ‘ওদের ক্লাব ক্রিকেটে একটা ক্লাবের চারটা গ্রেডের টিম থাকে। গ্রেড ওয়ান, গ্রেড টু, গ্রেড থ্রি, গ্রেড ফোর। এ ছাড়া সব ক্লাবের বয়সভিত্তিক এবং নারী দলও আছে। অনূর্ধ্ব-১৯ খেলার পরেই এখানকার ক্রিকেটারদের কোনো একটা ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। আমাদের দেশে ক্লাব ক্রিকেট, অনূর্ধ্ব-১৯ এর পর এইচপি কিংবা বাংলাদেশ টাইগার্সে যায়। ওদেরটা ভিন্ন। বয়সভিত্তিক দলের খেলা শেষে ক্লাবের অধীনে ভালো খেলোয়াড় হলে গ্রেড ওয়ান, একটু কম ভালো হলে গ্রেড টু– এভাবে সুযোগ পান। কোয়ালিটি অনুযায়ী গ্রেড ঠিক করে কোচরা।’
My time in Perth with UWACC flew by in what felt like moments, but the experience will stay with me for a long time. I’m...
Posted by Talha Jubaer on Monday, October 20, 2025বিজ্ঞাপন
অস্ট্রেলিয়ার ক্লাব ক্রিকেটের নিয়ম-কানুন এবং খেলোয়াড়দের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ মুগ্ধ করেছে তালহাকে। লম্বা সময় বাংলাদেশের পেশাদার ক্রিকেটে যুক্ত থাকা এই কোচ বলেন, ‘ওদের ক্লাব ক্রিকেটে অ্যাস্টন আগার খেলে; করি রচিকলি খেলে, অফস্পিনার নাথান লায়ন অবসরের পরেই অস্ট্রেলিয়া দলে ঢুকবে। উইল বসিস্ট খেলে। এসব খেলোয়াড়রা ক্লাবের হয়ে খেলছে, বড় ক্রিকেটার হলেও ক্লাবের নিয়মের বাইরে একদমই যায় না। সবাই অনেক হেল্পফুল এবং রেস্পেক্টফুল। কোচের নির্দেশনা মেনে চলে। এ ছাড়া নিজেরা নিজেদেরকে ফিডব্যাক দেয়। দুর্বলতা নিয়ে কাজ করে।’
ক্লাব ক্রিকেট থেকে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে তালহা বলেন, ‘গ্রেড ওয়ানে ভালো করলে ফার্স্ট ক্লাসের দলে ডাক পায়। ফার্স্ট ক্লাসে গেলেই কেবল টাকা পাওয়া যায়। এর আগপর্যন্ত পুরোটা খরচই নিজের। ক্লাবে খেলার জন্য প্রতি বছর ফি ফিতে হয়। জার্সি নিজের এবং খেতে হয় নিজ খরচে। ক্লাব শুধু খেলার সুযোগটা দেবে আর ভালো খেললে হয়তো ইনসেন্টিভ আছে। আমাদের যেমন প্রিমিয়ার লিগ, ওদের হলো ক্লাব ক্রিকেট। ফার্স্ট ক্লাসে খেললেও আপনাকে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে হবে। গ্রেড ওয়ান খেলে ক্রিকেটাররা ফার্স্ট ক্লাসে যায়। সেখানে আবার ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি এবং লাল বলের খেলা আছে। সেখানে পারফর্ম করে সুযোগ পায় জাতীয় দলে।’
ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার পাইপলাইন বরাবরই অন্যতম সেরা। এই পাইপলাইনের পেছনে স্কুল ক্রিকেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে জানিয়েছেন জুবায়ের। তার মতে, স্কুলগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা এবং বোর্ড কর্তাদের নজরদারি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করছে।
এ প্রসঙ্গে তালহা জুবায়ের বলেন, ‘ওদের স্কুল ক্রিকেটের সুবিধা দারুণ। একেকটা মাঠ দেখার মতো। প্রতিটি স্কুলে এমন ২-৩টা করে আন্তর্জাতিক মানের মাঠ আছে। মাঠ যেমন দারুণ, উইকেটও তেমন। এরকম হাজার হাজার স্কুল আছে এখানে। ক্রিকেটারদের বয়স চুরিরও কোনো ব্যাপার নেই। জন্ম সনদ অনুযায়ী যার যেটা বয়স সেটাই আসল। এখানে এসে দেখলাম, বোর্ড পরিচালকরা ব্যস্ত স্কুল ক্রিকেটে কোন ছেলে কেমন খেলছে, তখন কিন্তু ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ চলছে। বিষয়গুলো আসলে এরকম। ওরা নিচের দিকে অর্থাৎ ক্রিকেটারদের ভিত্তি তৈরিতে যে মনোযোগটা দেয় তাই ওদের পাইপলাইন শক্ত।’
তালহা কথা বলেছেন দেশের পেসারদের নিয়েও। তার মতে, ২০১৭-১৮ সালের পর থেকেই বাংলাদেশে পেস বোলিংয়ে একটা বিপ্লব শুরু হয়েছে। বয়সভিত্তিক দল থেকে অনেক পেসার উঠে আসছে। এসব পেসারদের মধ্যে তাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছেন রোহানাত দৌলা বর্ষণ, মুশফিক হাসান, রিপন মণ্ডল, আল ফাহাদ ও ইকবাল হোসেন ইমন। এখান থেকেই ভবিষ্যতের তারকা উঠে আসতে পারে তার প্রত্যাশা।
এর আগে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েও লম্বা সময় কাজ করেছেন তালহা জুবায়ের। তাই বেশিরভাগ খেলোয়াড়কেই ভালোভাবে জানেন তিনি। জানালেন সবার দুর্বলতা এবং শক্তির জায়গাও। বাংলাদেশের পাইপলাইনে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা পেসার কারা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বর্ষণকে আমার রেডি পেসার মনে হয়েছে, স্মার্ট বোলার। মুশফিক ভালো করবে। রিপন মন্ডল ভালো, কিন্তু আরও মাথা ব্যবহার করতে হবে। আশিকের ইনজুরিটা কষ্ট লাগে, খেলতে পারছে না, সেইম মুশফিকও। এ ছাড়া এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ এর ইমন এবং ফাহাদও ভালো অবস্থানে আছে।’
এদের বাইরে মারুফ মৃধা এবং নাহিদ রানাকে নিয়েও আশা দেখছেন জুবায়ের। তবে দুজনের বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করেন তিনি, ‘মারুফ মৃধা যদি আরও পেস জেনারেট করতে পারে, তাহলে ভালো করবে। এই গতিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা মুশকিল। নতুন বলের ওপর নির্ভর করলেই হবে না। বল পুরনো হয়ে গেলেও তো ভালো করতে হবে। নতুন বল থাকে কত ওভার! ইনসুইং, আউট সুইং এবং রিভার্স- সবকিছুই শিখতে হবে।’
নাহিদ রানার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নাহিদ রানাকে নিয়ে চিন্তা ভালো জায়গায় বল করা নিয়ে। সবাই মনে করে ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল করাই মূখ্য। আমি বরাবরই বলেছি ওকে ১৫০ গতিতে বল করলেই হবে না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যদি আউট করতে না পারো বা ভালো জায়গায় বল না করতে পারো, তাহলে কিছু হবে না। ওর ওয়ার্ক এথিকস ভালো। কিন্তু আরও ডিটেইলে কাজ করা উচিত ওকে নিয়ে।’
বাংলাদেশের পেসারদের উঠে আসার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতাও চিহ্নিত করেছেন জুবায়ের, ‘শুধু পেস বোলার উঠে আসলে তো হবে না। তাদেরকে পেস বোলিংয়ের উইকেট দিতে হবে। এ ছাড়া আমরা রোজার মাঝে গরমের সময় খেলি প্রিমিয়ার লিগ। এখানে পেস বোলাররা আশা হারিয়ে ফেলে, কারণ এটা তো কষ্টের কাজ। এখানেই তো তাদের ডিমোটিভেট করা হয়। কারণ ম্যাচের দিন রোজা না রাখলেও আগেরদিন রাখে অনেকেই। এগুলো সমস্যা।’
এসএইচ/এএইচএস