গরমে খেলার সময় হঠাৎ দেখা যায় কোনো খেলোয়াড় মাটিতে বসে পড়েছেন, কেউ পা ধরে আছেন, কেউ আবার কষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছেন। বিশেষ করে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল মাঠে এই দৃশ্য এখন নিয়মিতই দেখা যায়। এমন চোটের প্রবণতা আগের চেয়ে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া আগের মতো নেই। এখন প্রায় সারা বছরই গরম আর আর্দ্রতা থাকে। এই তাপ আর ক্লান্তির মধ্যে খেলোয়াড়দের শরীর দ্রুত ঘাম ঝরায়, পানি-লবণ কমে যায়, আর তখনই দেখা দেয় পেশিতে টান। অনেকে বলেন, ‘পানি না খাওয়ার কারণে হয়।‘ কিন্তু আমি মাঠে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আসলে বিষয়টা এত সহজ না। পেশিতে টান মানে শরীরের প্রতিবাদ। যখন শরীর অতিরিক্ত পরিশ্রম করে, তখন স্নায়ু আর পেশীর মধ্যে সমন্বয় নষ্ট হয়ে যায়। ফলেই টান ধরে যেন শরীর নিজেই বলে ওঠে, ‘আমি ক্লান্ত, একটু বিশ্রাম দরকার।‘

অনেক সময় অতিরিক্ত গরম, ডিহাইড্রেশন বা মানসিক চাপ এই সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে-

১. অতিরিক্ত পরিশ্রমে পেশী দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
২. মানসিক চাপ পেশীর প্রতিক্রিয়া কমিয়ে দেয়।
৩. শক্তির ঘাটতিতে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়। 
৪. শুধু ইলেকট্রোলাইট কম থাকলেই নয়, ক্লান্ত পেশীও টানের কারণ।
৫. ঘামে লবণ কমে গেলে স্নায়ু বিভ্রান্ত হয়।

অর্থাৎ, ‘পানি না খাওয়া’ একমাত্র কারণ নয় এর পেছনে কাজ করে গরম, ক্লান্তি, শক্তির ঘাটতি আর বিশ্রামের অভাব।

এখন গরম যেন বছরের সঙ্গী

আগে শীতকাল ছিল খেলার সময়। এখন সেই দিন আর নেই। দেশে গড় তাপমাত্রা বাড়ছে, আর্দ্রতাও অনেক বেশি। ২০২৪ সালের প্রচণ্ড গরমে অনেক খেলোয়াড় মাঠেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এমন গরমে শরীর ঘাম দিয়ে ঠান্ডা হতে পারে না, ভেতরে তাপ জমে যায়, ফলে শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

১. অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপমাত্রা কমে না।
২. ঘুম ঠিকমতো হয় না।
৩. শরীরের পানি-লবণের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
৪. দীর্ঘ সময়ের গরমে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে—দক্ষিণ এশিয়ায় গরমে সম্পর্কিত অসুস্থতা বাড়ছে, আর বাংলাদেশ এখন অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।

মাঠের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা

চলমান জাতীয় ক্রিকেট লিগে এক সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে পেশির টান ধরার কারণে মাঠের বাইরে যেতে হয়েছে। এটা শুধু ক্লান্তির নয়, বরং অতিরিক্ত গরম, পানিশূন্যতা ও সঠিক প্রস্তুতির অভাবের সম্মিলিত প্রভাব। এখন সময় এসেছে শুধু ফিটনেস নয়, বরং গরমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া প্রস্তুতিকেও গুরুত্ব দেওয়ার।

কিছু ভুল ধারণা-

১. ‘বেশি পানি খেলেই হবে।‘ - এতে শরীরের লবণ কমে যেতে পারে, উল্টো সমস্যা বাড়ায়।
২. ‘স্ট্রেচিং করলেই ঠিক হয়।‘ - এটা সাময়িক আরাম দেয়, কিন্তু মূল কারণ দূর করে না।
৩. ‘শুধু নতুন খেলোয়াড়দের হয়।‘ - অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রাও এই সমস্যায় পড়েন।
৪. ‘শুধু গরমে হয়।‘ - ঠান্ডা আবহাওয়াতেও শক্তির ঘাটতিতে টান ধরতে পারে।

প্রতিরোধের কিছু সহজ উপায়

১. পেশী শক্তিশালী করুন, রেসিস্ট্যান্স ব্যায়াম আর সহনশীলতা ট্রেনিং পেশীর সহ্যক্ষমতা বাড়ায়।
২. ঠিক মতো খাবার খান, খেলার আগে ভাত, ফল, কলার মতো কার্বোহাইড্রেট; খেলার পরে প্রোটিন ও ইলেকট্রোলাইট (ডাবের পানি)।
৩. পানি খান বুঝে শুনে, পিপাসা অনুযায়ী পানি খান, হালকা লবণযুক্ত পানি বা ইলেকট্রোলাইট ড্রিঙ্ক রাখুন, প্রতি ২০–৩০ মিনিট পরপর অল্প করে খান।
৪. স্নায়ু-পেশীর সমন্বয় বাড়ান, ব্যালান্স বোর্ড, কোর এক্সারসাইজ, রিঅ্যাকশন ট্রেনিং করুন।
৫. দ্রুত আরামের উপায়, টান ধরলে হালকা স্ট্রেচিং, ঠান্ডা তোয়ালে বা সামান্য পিকল জুস খেলে আরাম পাওয়া যায়।
৬. রিকভারি জরুরি, ম্যাচের পর গোসল করে নিন, বিশ্রাম নিন, আর রাতে অন্তত ৭ ঘণ্টা ঘুমান।

প্রস্রাবের রং দেখে বুঝে নিন শরীর ঠিক আছে কি না-

একদম স্বচ্ছ – শরীরে লবণ কমে যেতে পারে, পানি খান একটু কম, লবণযুক্ত তরল নিন।
হালকা হলুদ – শরীর ঠিক আছে।
গাঢ় হলুদ – ডিহাইড্রেশন, পানি ও ইলেক্টলাইট খান এখনই।

‘Heat Smart Athlete’ হওয়া দরকার এখনই

বিশ্বজুড়ে এখন গরমে অনুশীলনের জন্য আলাদা নিয়ম তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশেও সেই প্রস্তুতি নিতে হবে

যা করা যেতে পারে:

১. তাপমাত্রা WBGT (The Wet Bulb Globe Temperature) ৩০ ডিগ্রী ছাড়ালে অনুশীলনের সময় কমিয়ে দেওয়া।
২. সকাল বা বিকেলে ট্রেনিং করা।
৩. খেলার আগে ৭–১০ দিন গরমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অনুশীলন করা।
৪. প্রতিদিন পানি পানের পরিমাণ ও ঘুম পর্যবেক্ষণ করা।
৫. খেলার পর কুলডাউন আর গোসল বাধ্যতামূলক রাখা।

পরামর্শ

প্রতিদিন মাঠে খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখি পেশিতে টান ধরা অনেক সময় আগেভাগেই ঠেকানো যেত। যারা নিজের শরীরের যত্ন নেন, তারা সাধারণত এসব সমস্যায় কম পড়েন।

গরমে মানিয়ে নিতে অনুশীলন করুন, ৭–১০ দিন ধীরে ধীরে অনুশীলনের সময় আর তীব্রতা বাড়ান।
শুধু পানি নয়, ইলেকট্রোলাইটও প্রয়োজন, ডাবের পানি বা হালকা লবণযুক্ত পানি খুব ভালো কাজ করে।
ঘুম আর বিশ্রাম অপরিহার্য, ঘুম কম হলে শরীর পুরোপুরি সেরে উঠতে পারে না।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন, শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন বা কয়েক মিনিট শান্তভাবে বসে থাকা স্নায়ুর ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

সবশেষে বলব শরীরে যখন টান ধরে, সেটাকে অবহেলা করবেন না। শরীরের সংকেত বুঝে আগেভাগে যত্ন নিলেই বড় সমস্যাগুলো এড়ানো যায়। পেশিতে টান মানে শরীরের প্রতিবাদ ‘আমি ক্লান্ত, একটু যত্ন নাও।‘ এই বার্তা না শুনলে একসময় শরীরই সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আজকের খেলোয়াড়দের শুধু ফিটনেস নয়, আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও দরকার। ঠিক মতো খাওয়া, বিশ্রাম, অনুশীলন আর সচেতনতা এই চারটা জিনিস ঠিক রাখলে ভালো পারফরম্যান্স অনেকদিন টিকবে। পরিমান মতো পানি খান, নিয়ম মেনে বিশ্রাম নিন। কারণ এখন শরীরের প্রতিটি ঘামের ফোঁটাই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : সাইফুদ্দিন আহমেদ, স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্ট, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। 

এইচজেএস