মুশফিকুর রহিম, নামটি শুনলেই সবার আগে মানসপটে ভেসে ওঠে পরিশ্রমী এক ক্রিকেটারের ছবি। ২০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি বাংলাদেশের কত আনন্দ-বেদনার সঙ্গী হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। মাঠের বাইরে মুশফিকের ব্যক্তিগত নিবেদন ও সাধনা কারও অজানা নয়। যা কাছ থেকে দেখা মানুষদের কাছে তাকে অতুলনীয় করে তুলেছে। ভোর থেকেই অনুশীলন, সবার আগে মাঠে হাজিরা কিংবা নিরন্তর ঘাম ঝরানো নিয়ে মুশফিক অনেকবারই আলোচনায় এসেছেন।

‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন টেস্ট ফরম্যাট দিয়ে। এখন তার সামনে কেবল সেই দীর্ঘ সংস্করণেরই দরজা খোলা। বাকি দুই ফরম্যাটকে (ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি) তিনি ইতোমধ্যে বিদায় জানিয়েছেন। আগামীকাল (বুধবার) আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে নামলে দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০তম টেস্ট খেলার গৌরব অর্জন করবেন মুশফিক। দেশের ক্রিকেট এমন কিছু কখনও দেখেনি। যে অর্জন আনন্দের, মর্যাদার ও অহংকারের। 

ঐতিহাসিক লর্ডসে ২০০৫ সালের ২৬ মে সাদা পোশাকে শুরু। এরপর একে একে কেটেছে ২০ বসন্ত। বাংলাদেশের তৎকালীন অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের হাত থেকে পাওয়া ‘ব্যাগি গ্রিন’ ক্যাপটি এতদিনে ধূসর রূপ নিয়েছে; কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি নিবেদনে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি মুশফিকের। সেই শুরুর দিনে যেমন ছিল, এখনও তেমনই রয়েছে। 

মুশফিক ক্লাসের সেই ছাত্র, যার পরিশ্রম-একাগ্রতা ও অধ্যাবসায় দেখে মুগ্ধ হন কোচরা। বাংলাদেশে কাজ করে গেছেন কিংবা এখনও শিষ্যদের গড়ায় নিয়োজিত আছেন এমন কোচদের চোখে মুশফিক অনন্য। এমনকি নতুনদের এই উইকেটরক্ষক ব্যাটারকে রোল মডেল হিসেবেও মানতে বলছেন কোচেরা।

মুশফিকের শততম টেস্টের আগে বাংলাদেশ দলের হয়ে কাজ করা বেশ কয়েকজন কোচের কথা শুনেছেন ঢাকা পোস্টের ক্রীড়া প্রতিবেদক সাকিব শাওন। তাকে শুভকামনা জানিয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে কোচিং করানো চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, স্টুয়ার্ট ল, জেমি সিডন্স, অ্যালান ডোনাল্ড, শ্রীধরন শ্রীরাম ও নাভিদ নেওয়াজ।

দুই দফায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। সাবেক এই কোচ বলেন, ‘মুশফিক এমন এক ক্রিকেটার, যার সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মনোযোগী ও পরিশ্রমী খেলোয়াড়দের একজন। ম্যাচের আগে তার প্রস্তুতি একেবারে বিশ্বমানের। পরিকল্পিত, শৃঙ্খল এবং একই রকম ধারাবাহিক। মিরপুরে বা বিদেশের কঠিন কন্ডিশনে খেলা, কখনোই মুশফিক তার মান কমতে দেয় না। প্রতিদিনই খুব সকালেই পৌঁছে যায়, উইকেট-পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখে, আর নিশ্চিত করে প্রতিটি অনুশীলন সেশন যেন পরিপূর্ণ হয়। তাকে পর্যবেক্ষণ করাই তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য যথেষ্ট। একজন প্রকৃত পেশাদার কাকে বলে, সেটা দলের তরুণরা তার কাছ থেকেই শিখতে পারে।’

নিজের কোচিং ক্যারিয়ারে মুশফিকই সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও সৎ নেতাদের একজন বলে জানিয়েছেন হাথুরুসিংহে, ‘টেকনিক্যাল দক্ষতা আর মানসিক দৃঢ়তার বাইরে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে, তা হলো তার চরিত্র। মুশফিক এমন একজন নেতা, যার প্রতি ভরসা রাখা যায়। সে সত্যিই দলের জন্য আন্তরিক। পৃথিবীর যেসব দলের কোচিং করেছি, তাদের মধ্যে মুশফিক সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও সৎ নেতাদের একজন। দলের মানদণ্ড ঠিক করে দেন। কথার চেয়ে কাজ দিয়ে নেতৃত্ব দেন। আর যখন সে কথা বলে, দলের সবাই মন দিয়ে শুনে। এটা কেবল সে সিনিয়র এই কারণে নয়, বরং সবাই জানে, তার প্রতিটি সিদ্ধান্তই দলের জন্য নেওয়া।’

২০১১–১২ সালে বাংলাদেশের প্রধান কোচ ছিলেন স্টুয়ার্ট ল। মুশফিককে শুভেচ্ছা জানিয়ে সাবেক এই গুরু বলেন, ‘দেশের হয়ে শততম টেস্ট খেলার জন্য অভিনন্দন মুশি। আমার দেখা অন্যতম সেরা এক পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে তোমাকে এই মাইলফলক স্পর্শ করতে দেখা, মোটেই বিস্ময়কর নয়। তুমি নিজের ও পরিবারের জন্য আর বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এক গর্ব। অসাধারণ! 

সাবেক প্রধান কোচ জেমি সিডন্স বলেন, ‘মুশি আমাদের দলে সবচেয়ে পেশাদার এবং সবচেয়ে পরিশ্রমী ছিল। বাকিদের চেয়ে বেশি বল খেলে আর নিজেকে সুপার ফিট রাখে। এভাবেই সে এতদিন নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ধরে রেখেছে। খুবই আত্মপ্রত্যয়ী আর ফোকাসড একজন ক্রিকেটার, যে এত বছরে প্রচুর সাফল্য পেয়েছে। এত উজ্জ্বল দিক আর স্পেশাল মুহূর্ত আছে, একটা বেছে নেওয়া কঠিন। আমি কোচ থাকাকালে তার একটি ছক্কা এখনও স্মরণীয়। অভিনন্দন মুশি। কী অসামান্য এক ক্যারিয়ার।’

বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাবেক পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড মুশফিককে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘কী অসাধারণ একটা অর্জন মুশফিকের জন্য। শততম টেস্ট খেলাই তার ক্যারিয়ার, পরিশ্রম এবং পেশাদারিত্ব নিয়ে অনেক কিছু বলে দেয়। খেলার জন্য তার যে তাড়না... সে এমন অনেক টেস্টে যুক্ত ছিল যেখানে তাকে অনেক চাপ নিয়ে দলকে কঠিন অবস্থা থেকে এগিয়ে নিতে হয়েছে। অনেক বারই সে দলের জন্য এগিয়ে এসেছে।'

বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড় নাম হওয়ার স্বপ্ন দেখে, এমন তরুণদের জন্য মুশফিককে উত্তম আদর্শ বলে মনে করেন ডোনাল্ড, ‘আমার মনে পড়ে, আমি যখন বাংলাদেশে ছিলাম, তখন একটা নিবন্ধে লিখেছিলাম, মুশি যেকোনো তরুণ বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের জন্য উদাহরণ। পেশাদারিত্বের জন্য, কীভাবে পেশাদার অ্যাথলেটদের পথচলা সাজাতে হয়...সেজন্য। কিপার, ব্যাটার– দু’দিক থেকেই সে অগ্রগণ্য। সবসময় কঠিন পরিশ্রম করে। নিয়মিত চাপ নিয়ে সে ফিটনেস ঠিক রাখে। যখন কিপিং অনুশীলন থাকে, সে কিছু তরুণদের সঙ্গে নেয়। আর খুব ভালোভাবেই অনুশীলনগুলো শেষ করে।’ 

সাবেক শিষ্যকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকান এই কিংবদন্তি পেসার, ‘আমার চোখে সে পেশাদারি আচরণের সর্বোচ্চ উদাহরণ। এটাই একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের বৈশিষ্ট্য। আমরা প্রথম শ্রেণি ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথাই বলি। আপনার কেবল ধৈর্য নিয়ে দেখতে হবে– মুশি প্রতিদিন ঠিক কী কী করে। তখনই বুঝতে পারবেন, এই স্ট্যান্ডার্ড আসলে কেমন। এটা অসামান্য এক অর্জন। তার খেলার প্রতি আগ্রহকে আমি সম্মান করি।’

‘সে যেভাবে খেলাকে দেখে... দেখুন, সে সত্যিই অসাধারণ খেলে এসেছে। যেমনটা বললাম, সে অনেক কিছুই করেছে৷ আমি তাকে শুভকামনা জানাই। সে অসামান্য একজন পারফর্মার। অসামান্য ক্রিকেটার। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই, তার যদি আগ্রহ থাকে তবে আরও কিছু দিন মুশি খেলে যাবে’, আরও যোগ করেন অ্যালান ডোনাল্ড।

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুম সামলানো সাবেক কোচ শ্রীধরন শ্রীরাম জানিয়েছেন, ‘অসামান্য অর্জন। সে সত্যিই এই সম্মানের প্রাপ্য। সবদিক বিবেচনায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের কিংবদন্তি। তার জন্য শুভকামনা।’

বাংলাদেশ যুব দলের প্রধান কোচ নাভিদ নেওয়াজ বলছেন, ‘এটি আমাদের সবার জন্য গর্বের এক মুহূর্ত। মুশফিকুর রহিম তার ১০০তম টেস্ট ম্যাচে পৌঁছালেন। এই মাইলফলক তার অসাধারণ শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের অনন্য উদাহরণ। মুশি সবসময়ই এমন একজন খেলোয়াড়, যিনি কাজের প্রতিশ্রুতি, প্রস্তুতি এবং ক্রমাগত উন্নতি দিয়ে মানদণ্ড তৈরি করেন। ব্যাট হাতে, স্টাম্পের পেছনে বা ড্রেসিংরুমে—যেখানেই থাকুন, সে সবসময়ই প্রকৃত পেশাদার এবং আমাদের সিস্টেমে উঠে আসা প্রতিটি তরুণ ক্রিকেটারের অনুপ্রেরণা।’

তিনি আরও বলেন, ‘চাপের পরিস্থিতিতে তার আবেগ, তার লড়াই আর পারফর্ম করার ক্ষমতা তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পারফর্মার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট কোচিং গ্রুপ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত সবার পক্ষ থেকে, আমি মুশফিকুর রহিমকে এই অসাধারণ অর্জনের জন্য শুভেচ্ছা জানাই। তার জন্য রইল নিরন্তর সাফল্য, সুস্বাস্থ্য এবং দেশের জন্য আরও অনেক গর্বের মুহূর্ত তৈরির জন্য অগ্রিম শুভকামনা। সাবাস মুশি—তুমি সত্যিই এই অর্জনের প্রতিটি অংশের যোগ্য।’

এসএইচ/এএইচএস/এফআই