সাকিবের হলো কী
বাংলাদেশ ক্রিকেটের রাজপুত্র তিনি, পোস্টার বয় বা নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডারও। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের যত অর্জন আছে, সেখানে সাকিব আল হাসানের নিবেদন অস্বীকার করার উপায় নেই। সবচেয়ে বড় সমালোচকটিও আলাদা দৃষ্টি রাখেন সাকিবে, তার মাঠের পারফরম্যান্সে। আপনি সাকিবের সমালোচক হতেই পারেন, সেজন্য তাকে জানতে হবে সবার আগে।
‘সাকিব হাসলে হাসে বাংলাদেশ’- বলতেই পারেন, তবে ওই সময় পার করে এসেছে এদেশের ক্রিকেট। সাকিব ছাড়াও বাংলাদেশ হাসে। তবে এত বছর পরও একজন সাকিবের বিকল্প কি পেয়েছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা? এজন্য অবশ্য রেকর্ড বই উল্টানোর প্রয়োজন নেই। জোর গলায় বলতে পারেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের বিকল্প তৈরি হয়নি এখনো।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্থানীয় এক কোচ সম্প্রতি আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘সব তরুণ ক্রিকেটারই চায় সাকিবের মতো হতে। সাকিবকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা নেই কারও।’
ছোটবেলায় শোনা সেই ‘হাতি আর দড়ি—নিজের ওপর বিশ্বাসের গল্প’ মনে আছে? মনে না থাকলে একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
বিজ্ঞাপন
একবার এক ভদ্রলোক হাতির ক্যাম্পে প্রবেশ করেছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন অনেকগুলো হাতি আছে সেখানে কিন্তু একটা হাতিও কোনো খাঁচার ভেতরে নেই এবং কোনো হাতিই লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা নয়। বরং হাতিগুলোকে তাদের পায়ে ছোট্ট একটা দড়ি দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। এটা দেখে ভদ্রলোক খুব বিস্মিত হলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন এই বিশাল বিশাল হাতিগুলোর জন্য এই দড়ি ছিঁড়ে পালানো তো কোনো ঘটনাই নয়, তবু ঠিক কী কারণে এরা সেই চেষ্টাটাও করছে না!
প্রচণ্ড কৌতূহলী হয়ে সেই লোক ক্যাম্পের একজন ট্রেইনারকে খুঁজে বের করলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন ঠিক কী কারণে হাতিগুলো কখনোই দড়ি ছিঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে না? ট্রেইনার উত্তর দিলেন, এই হাতিগুলো যখন খুব ছোট ছিল তখন আমরা এই একই সাইজের দড়ি দিয়ে তাদের বেঁধে রাখতাম। তখন এই দড়িই হাতিগুলোকে বেঁধে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। তারা বিশ্বাস করতে করতে বড় হয়েছে যে এটা ছিঁড়ে বের হতে পারবে না। তাই, তারা এখনো বিশ্বাস করে এই দড়ি তাদেরকে এখনো আটকে রাখতে পারে, এই কারণে তারা এটা ছিঁড়ে বের হওয়ার চেষ্টাও করে না।
হাতি আর দড়ির এই গল্পের কিছুটা মিল খুঁজে পাবেন এখানে, আমাদের ক্রিকেটে। আমাদের তরুণ কোনো ক্রিকেটার এটা বিশ্বাস করতেই পারেন না যে, সাকিবকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এর ছাপ স্পষ্ট। নতুন অনেক মুখ তো এসেছে; কেউ থিতু হচ্ছে, কেউ ঝরে পড়ছে। দিনশেষে একজন সাকিবের বিকল্প কই?
মাঝে ‘ফিক্সিং প্রস্তাব’ গোপন করায় আইসিসির নিষেধাজ্ঞার খড়গে পড়েছিলেন সাকিব। সেটি কেবল এক বছরের। তারপরও কোথাও যেন ছন্দে ছেদ ঘটে গেছে। নিষেধাজ্ঞার আগের সাকিব আর নিষেধাজ্ঞার পরের সাকিবের মধ্যে মনে হচ্ছে বিস্তর ফারাক। মাঠের ক্রিকেট, পরিসংখ্যান সবই সে কথা বলছে। এক বছরের সাজা শেষে মাঠে ফিরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে কিছুটা চনমনে সাকিবকে দেখা গেলেও সময় যত গড়াচ্ছে কুপির সলতের মতোই যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে তার ব্যাটের তেজ। বোলিংয়েও যে লেটার মার্ক দিবেন, সে উপায় কই !
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ চলাকালীন চোট, সঙ্গে যুক্ত হলো ছুটি। নিউজিল্যান্ড সফরে গেলেন না সাকিব। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে গেলেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলতে। সেখানে ৩ ম্যাচ খেলে একাদশে জায়গা হারালেন। সে তিন ম্যাচে ব্যাট থেকে আসল মোটে ৩৮ রান!
এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে তার ব্যাট থেকে আসে মাত্র ১৯ রান! রান পাননি ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগেও। ৮ ম্যাচে সর্বসাকুল্যে ১২০ রান করেন তিনি। কোথাও নেই একটি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৭৪ রান করলেও একমাত্র টেস্টে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ৩ রান করে আউট হন। ২য় ইনিংসে নামার সুযোগ হয়নি। ব্যাট হাতে এমন হতশ্রী সময় শেষ কবে কাটিয়েছেন সাকিব?
ক্রিকেটারদের টেকনিক্যাল ও মানসিক দিকগুলোতে উন্নতি সাধনের জন্য টোটকা দেয়ার জন্য বিখ্যাত নাজমুল আবেদীন ফাহিম। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিকেএসপিতে ক্রিকেট কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল বিসিবির গেম ডেভলপমেন্ট বিভাগে কাজ করে দেশের ক্রিকেটের পাইপলাইন সমৃদ্ধ করেছেন। ক্রিকেটাররা যখন কোন সমস্যায় পড়েন কিংবা বাজে ফর্মে থাকেন, তখন তারা ‘ফাহিম স্যার’-এর শরণ নেন। সাকিবও এর ব্যতিক্রম নন।
কোথায় সমস্যা হচ্ছে সাকিবের? নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, ‘ওর ব্যাটিংয়ে কিছুটা অসুবিধা তো হচ্ছেই। আমরা ওর ব্যাটিং যেভাবে দেখে অভ্যস্ত, সেভাবে ঠিক হচ্ছে না। কোথাও একটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। সে নিজেও এই জিনিসটা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। আমার মনে হয় এজন্যই ও সময় নিয়ে ব্যাটিং করছে বোঝার জন্য। সে যেন নিজের ব্যাটিংটা বুঝতে পারে সেই চেষ্টাই করছে।’
ফাহিমের টোটকা, ‘ইদানীং লক্ষ্য করছি ও শুরুতেই আক্রমণাত্মক খেলার চেষ্টা করছে। এটা ভালো ফল দিচ্ছে না। সে প্রতি ইনিংসে এভাবেই আউট হচ্ছে। যখন বড় শট খেলতে যাচ্ছে, তখনই কিন্তু আউট হচ্ছে বেশি। আমার মনে হয় এ জায়গায় একটু মনঃসংযোগ ধরে রাখতে হবে। তার কোচরা আছেন, তাদের সাথে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।’
‘জীবনে ভালো দিন, খারাপ দিন দুটোই থাকবে। তোমার কাজ হবে সামনে এগিয়ে যাওয়া।’- উসাইন বোল্টের ভাষায় বলতে গেলে, প্রতিটি খেলোয়াড়ের সুদিন আসে, দুর্দিনেরও সঙ্গী হতে হয়। নিষেধাজ্ঞার ঠিক আগে, ২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে রীতিমতো বাজিমাত করেন সাকিব। ৮ ম্যাচে প্রায় ৮৭ গড়ে ৬০৬ রান করেন তিনি। ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তৃতীয় স্থানে। যেখানে টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৫টি ফিফটির সঙ্গে ২টি সেঞ্চুরিও করেন সাকিব।
তবে কি ব্যাট হাতে সুদিন পেছনে ফেলে এসেছেন তিনি? ফাহিম অবশ্য যুক্তি দিয়ে বোঝালেন, সেদিন এখনো আসেনি সাকিবের, ‘আমার মনে হয় না সে ব্যাটিংয়ে তার সেরা সময়টা ফেলে এসেছে। সেরা সময় তো তখনই শেষ হয়ে যায় যখন তার সক্ষমতা থাকে না, তার ফিটনেস থাকে না। তখন আমরা বলতে পারব সাকিবের ব্যাটিংটা আর আগের মতো নেই। সাকিব কিন্তু এখনো সেই জায়গাতে আসেনি। সে এখনো যথেষ্ট পরিমাণ ফিট এবং প্রতিবার ব্যাটিংয়ে নামার পর তার রানের ক্ষুধা কতটা, তা দেখা যায় তার ব্যাটিং স্টাইলে। আমার মনে হয় কোনো টেকনিক্যাল কারণে এমনটা হচ্ছে। সেটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই আবার পুরোনো সাকিবকে দেখা যাবে।’
একটি বিষয় লক্ষণীয়, সাকিব মাঠের পারফরম্যান্স ধরে রাখতে অনুশীলনে বাড়তি সময় দিচ্ছেন। সুযোগ পেলেই ব্যাট হাতে নেমে যাচ্ছেন নেটে। তবে মাঠের বাইরের খেলাটাও নেহায়েত মন্দ খেলছেন না। সম্প্রতি যে চাপা আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট, তার শুরুটা সাকিবের হাত ধরেই। সে জল তো অনেকদূর গড়িয়েছে, অজানা নয় কারও।
সাকিবের কি তবে মাঠের বাইরের খেলাতেই বাড়তি মনোযোগ?- সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
সাকিব বাংলাদেশে থাকলেও তার পরিবার থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। স্ত্রী আর তিন সন্তান আছে সেখানে। নিষেধাজ্ঞা শেষ করে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন সাকিব। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে ছুটে যান ২২ ফেব্রুয়ারি। আবার ফেরেন ২৩ মার্চ। মাঝে জিম্বাবুয়ে সফরের আগে গিয়ে থেকে এসেছেন আরও ১২ দিন। সব মিলিয়ে ৪০ দিনের মতো দেশে ছিলেন না টাইগার অলরাউন্ডার। বাকি সময়গুলো কেটেছে কোয়ারেন্টাইন, খেলা আর জৈব সুরক্ষা বলয়ে।
এসব যাওয়া-আসা, ছুটি, আইপিএল, করোনা, বিতর্ক কি এক ধরনের চাপ তৈরি করছে সাকিবের ওপর? তার কি একান্ত নিজের মতো কিছু সময়ের প্রয়োজন? ফাহিম অবশ্য তেমনটা মনে করছেন না, ‘আমার মনে হয় না ওর কোনো বিশ্রামের দরকার আছে। সে নিজেও জানে তাকে রানে ফিরতে হলে কী করতে হবে। যতদিন না রানে ফিরছে, সে নিজেও কোনো স্বস্তি পাবে বলে মনে হয় না। আমার মনে হয় মাঠে থেকে ম্যাচ খেলেই রান খরা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। যত বেশি ম্যাচ খেলবে বিষয়টা তত সহজ হবে ওর জন্য।’
দিন শেষে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান একজনই। তিনি যত দ্রুত স্বরূপে ফিরবেন, আখেরে লাভ এদেশের ক্রিকেটেরই। সাকিব ফিরে আসুক তার আপন মহিমায়, বাংলাদেশ ক্রিকেট আরও সমৃদ্ধ হোক তার ব্যাটে, তার বলে।
টিআইএস/এটি/জেএস