ফুটবলপ্রেমী ইসমাইলের স্বপ্ন দাবিয়ে রাখতে পারেনি বসন্ত রোগ
শরীয়তপুরের ইসমাইল হোসেন নিজ গ্রামে ওস্তাদ নামে পরিচিত। ফুটবল খেলার জন্যই এই পরিচিতি তার। ইচ্ছে ছিল জাতীয় দলের খেলোয়ার হওয়ার। নিজের সম্পূর্ণ যোগ্যতা থাকার পরেও বিধি বাম বলে তৎকালীন নামীদামি ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়েও হারিয়েছেন সেটি। বসন্ত রোগের কারণে ব্রাদার্স ইউনিয়ন থেকে বাদ পড়ার পর একটানা কয়েক বছর অসুস্থ হয়ে একাকী ঘরে পরেছিলেন তিনি। সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ফুটবলের সঙ্গে। কিন্তু স্বপ্নকে কি দাবিয়ে রাখা যায়! নামীদামি ক্লাবে বা জাতীয় দলে নিজে খেলতে পারেননি বলে থেমে যাননি ডিফেন্ডার ইসমাইল হোসেন। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামের ছেলেদের ফুটবল খেলা শিখিয়ে যাচ্ছেন তিনি। স্বপ্ন একটাই, এই ছেলেদের মধ্যে যদি কেউ একদিন জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পায়, তাহলেই নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ হবে তার।
অনার্স-মাস্টার্স পাশ শিক্ষিত মানুষ হয়েও নিজের একটি স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে জীবনের ৫৮ টি বছর কখনো হননি সংসারি, জড়াননি কোনো পেশায়। প্রায় ৬০ বছর বয়সী ইসমাইল হোসেন মাদবর স্ত্রীর অনুরোধে ২০২১ সালে বার কাউন্সিলের সনদ নিয়ে এখন পেশায় একজন আইনজীবী হলেও গাঁয়ের ছেলেদের নিয়ে সকাল-বিকাল পড়ে থাকেন শরীয়তপুরের চিকন্দী ইউনিয়নের মসজিদ মাঠ, বুড়ির হাট, ডোমসারসহ বিভিন্ন ফুটবল খেলার মাঠে।
বিজ্ঞাপন
ইসমাইল মাদবরের কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যের সঙ্গী ফুটবল। কলেজ জীবনে ইসমাইল হোসেনের ফুটবল খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী ইসমত আরা। প্রণয়ের পরে অন্য দশজন গৃহবধুর মত ইসমত আরা স্বামী ইসমাইল হোসেনকে সংসারের দায়িত্ব নিতে একটি দিনের জন্যও বলেননি। বরং সারা জীবন ফুটবল প্রেমিক স্বামীর ফুটবল প্রীতিকে ভালোবেসে হাসি মুখেই বরণ করে নিয়েছেন সবকিছু।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সাথে কথা হয় নিভৃত গাঁয়ের ফুটবলের ওস্তাদ ইসমাইল হোসেন মাদবরের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে ফুটবল খেলা শুরু করি। তখন আমাদের দেশে ফুটবল ছিল না বললেই চলে। ছোটদের ফুটবল খেলার জন্য তখন প্রিয় বস্তু ছিল জাম্বুরা (বাতাবি লেবু)। জাম্বুরা দিয়েই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতাম। যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন সিনিয়রা আমার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাদের সাথে বিশেষভাবে তৈরী ফুটবল দিয়ে খেলার সুযোগ করে দেয়। মতি ভাই ও পুতুল ভাই নামের বড় ভাইদের উৎসাহে আমি বড়দের সাথে খেলা শুরু করি। ছোটরা আমার সাথে খেলতে সাহস করত না। আবার বড়দের সাথে খেলতে গেলে আমি অস্বস্তিবোধ করতাম।
বিজ্ঞাপন
ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা এখন যে কেডস (জুতা) পরি সেই কেডসের মতো এক ধরণের বস্তু পাওয়া যেত। ওই বস্তু বিশেষ কায়দায় সেলাই করে বড়রা ফুটবল তৈরী করে খেলত। বড়দের মধ্যে অনেকে আবার চাঁদা তুলে শহর থেকে ফুটবল কিনে নিয়ে আসত। আমরা ছোটরা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম। কিন্তু জাম্বুরা শক্ত হওয়ায় পায়ে আঘাত লাগত। আমার ঠিক মনে নেই, তবে কেউ একজন আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল জাম্বুরা সিদ্ধ করে নিলে জাম্বুরা দীর্ঘ মেয়াদী হবে ও পায়ে আঘাত পাবো না। তারপর থেকে প্রতিদিন আমরা সিদ্ধ জাম্বুরা দিয়ে খেলতাম। এরপর দেশ উন্নত হওয়া শুরু করলে ফুটবল বাজারে কিনতে পাওয়া যেত। আমরা ফুটবল দিয়ে খেলা শুরু করলাম। হোক জাম্বুরা, বিশেষ ভাবে সেঁলাইকৃত বল বা প্রকৃত ফুটবল, বুঝ হওয়ার পর থেকে কখনো আমি ফুটবল ছাড়িনি।
কৃষকের ছেলে ফুটবল প্রেমিক এই মানুষটি বলেন, বাবা কৃষক হওয়ায় স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে ফসলী জমিতে নিরানীসহ সকল প্রকার গৃহস্থ্য কাজ করতে হতো আমাকে। স্কুল থেকে এসে দ্রুত ফসলী মাঠের কাজটি শেষ করে দিয়ে আমি খেলতে যেতাম। একদিন বাবা পাশের ইউনিয়ন ডোমসারে গেলে আমার এক বন্ধুর বাবা আমার বাবা হাবিবুর রহমানকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন যে ইনি ফুটবলার ইসমাইলের বাবা। তখন আমাকে বাবাকে তারা সবাই সম্মান ও শ্রদ্ধা করেন। এরপর বাবা বাড়িতে এসে আমাকে বললেন এখন থেকে তোমাকে আর ফসলী মাঠে কাজ করতে হবে না। তুমি নিয়মিত মাঠে ফুটবল খেলবা।
ইসমাইল হোসেন আরও বলেন, বড়দের সাথে ঢাকায় একবার খেলতে গেলে ঢাকার রাজু ভাই নামে একজন আমাকে ঢাকার স্পোর্টিং ক্লাবে খেলার সুযোগ করে দেন। এরপর আমি ঢাকা, দিলকুশা, ওয়াশা, চলন্তিকা স্পোটিং ক্লাবসহ দেশের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলায় অংশ নিয়েছি। সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে আবহানী ও মোহামেডান ক্লাবের বিপক্ষে খেলার সুযোগ হলেও বসন্ত (পক্স) রোগের কারণে আর খেলতে পারিনি। তৎকালীন সময়ে বাবার সামর্থ্য ছিল না আমার চিকিৎসার খরচ বহন করার। তাই দীর্ঘদিন বাড়িতে অসুস্থ্য থাকায় মাঠে খেলতে পারিনি। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলে খেলার। স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলেই স্বপ্নকে পূরণ করতে গ্রামের শত শত ছেলেকে ফুটবল খেলার সুযোগ করে দিয়ে খেলা শেখাচ্ছি। যদি আমার কোনো শিষ্য আমার মরার পরেও জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পায় বা বাংলাদেশ বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলে সেখানে খেলার সুযোগ পায় তাহলে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে। আমি না পারলাম, আমার শিষ্য পারলেও আমার শ্রম স্বার্থক। তাছাড়া ফুটবল, গান বাজনা তরুণদের খারাপ সঙ্গ ও মাদক থেকে দূরে রাখে। আমি যখন থাকব না, তখন আমার একজন শিষ্য হয়ত জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাবে। কিন্তু আমি শত শত ছেলেকে মাদক থেকে দূরে রাখতে পেরেছি, এটাও তো জীবনে কম পাওয়া নয়।
কোনো প্রকার সরকারি সহায়তা বা দাতা সংস্থার সহযোগিতা ছাড়া নিজ উদ্যোগে ইসমাইল হোসেন দীর্ঘ ৪০ বছর গায়ের ছেলেদের ফুটবল খেলা শেখানোয় খুশি তার পরিবার ও স্থানীয় সাধারণ মানুষসহ জনপ্রতিনিধিরাও।
শরীয়তপুরের সেরা একটি টিম ইসমাইল হোসেনের হাতে গড়া চিকন্দী ফুটবল একাদশ। টিমের সদস্য রাজু খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ফুটবল স্কিল উন্নয়ন করতে পজিশন, এটাকিং, বল রিসিভ, ডেলিভারিসহ কীভাবে বিপক্ষ দলকে এটাক করতে হয়, কীভাবে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হতে হয় এসব কিছুই ওস্তাদ আমাদের শিখিয়েছেন।
ইসমাইল হোসেনের যৌবন বয়সের খেলার সাথী মিডল পয়েন্টের ফুটবল খেলোয়ার দীপক চন্দ্র দাড়িয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৮৫ সালে যখন আমি খেলা শুরু করি তখন আমাদের ওস্তাদ ছিলেন ইসমাইল ভাই। যারা বড় বড় ম্যাচে খেলেও বিভিন্ন কারণে ঝড়ে পড়েছেন আমি ইসমাইল ভাইকে তাদের মতো একজন মনে করি। ফুটবলে খুব উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছিল তার। আমিও ঢাকার ক্লাবে খেলেছি। ওস্তাদের সব কিছু ঠিক ছিল কিন্তু এক রোগ তার ফুটবলের প্রতিভাকে জাতির সম্মুখে আসতে দিল না। জীবনের শেষ বয়সে এসেও সে তার স্বপ্ন পূরণ করতে ফুটবলকে আঁকড়ে ধরে আছেন।
ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী ইসমত আরা অবসর প্রাপ্ত পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক। তিনি বলেন, যখন আমি কলেজে পড়াশোনা করতাম। তখন ইসমাইলের ফুটবল খেলা দেখতে আমি বান্ধিবীদের নিয়ে যেতাম। ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে ইসমাইলকে আমার ভালো লাগে। এরপর পরিচয় হয়, প্রেম হয়, বিয়ে হয়। তাকে আমি কোনোদিন খেলা ছাড়তে বলিনি। বরং উৎসাহ দিয়েছি। সংসারের প্রতি কখনো নজর দেয়নি সে, সারাদিন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। রাতে সে বিছানায় দুই তিনটা বল নিয়ে ঘুমাত। ঘুমের চোখে সে বল কিক করত। এমনই খেলা প্রিয় আমার স্বামী। বিভিন্ন স্থান থেকে যখন বিজয়ী হয়ে পুরষ্কার নিয়ে আসত তখন মনে হত লাখ টাকা নিয়ে এসেছে। আমি তার পুরষ্কার হাতে নিয়ে বলতাম চাকরি বাকরি দরকার নাই, তুমি খেলাধুলাই করবা। আমার শ্বশুর যা রেখে গেছেন আর আমার চাকরির উপার্জন দিয়ে সংসার পরিচালনা করি। এখনও সে গ্রামের মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাকটিস করায়। খেলোয়ার স্বামীকে নিয়ে আমি খুশি। শেষ বয়সে এসেও তার আমার খেলাধুলা ভালো লাগে।
চিকন্দী ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ড সদস্য ফারুক মাদবর ইসমাইল হোসেনের কাছে ফুটবল খেলা শিখেছেন এক সময়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ওস্তাদ ইসমাইল মাদবর ব্রাদার্স ইউনিয়নে চান্স পাওয়ার পরেও দুর্ভাগ্যক্রমে যখন খেলতে পারেনি। তখন সে প্রতিজ্ঞা করেছে গ্রামের ছেলেদের খেলা শেখাবেন এবং তাদের মধ্য থেকে একজন জাতীয় দলে চান্স পাবে। নিজের অপূরণীয় স্বপ্ন সে তার শিষ্যকে দিয়ে পূরণ করতেই জীবনের শেষ বয়সে এসেও গ্রামের ছেলেদের ফুটবল খেলা শিখিয়ে যাচ্ছেন।
শরীয়তপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইসমাইল হোসেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে খেলার সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু বসন্ত রোগের কারণে তিনি ক্লাবটিতে খেলতে পারেননি। ব্রাদার্স ইউনিয়নে খেলার সুযোগ পেলে ইসমাইলকে আমার অন্যভাবে পেতাম। শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ইসমাইল কৃতিত্বের সাথে ফুটবল খেলেছে। এখনও পর্যন্ত তিনি ফুটবল খেলা ধরে রেখেছেন। তার স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে। তার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি আমি।
শরীয়তপুরের চিকন্দী ইউনিয়নের আবুরা গ্রামের ফুটবল প্রেমী ইসমাইল হোসেন মাদবর-ইসমত আরা দম্পত্তির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে ইসরাত জাহান ইশিতা ও ছোট মেয়ে নুসরাত জাহান নিশু আইন বিভাগ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। তারা দুই বোনও ভালো ফুটবল খেলোয়ার। ছেলে ইব্রাহীম খলিলুল্লাহর বয়স প্রায় দুই বছর।
সাইফুল ইসলাম সাইফ রুদাদ/এফআই