ভুটান বাংলাদেশের ফুটবলে এক আতঙ্কের নাম। ২০১৬ সালে থিম্পুতে ১-৩ গোলে এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্লে অফে হেরেছিল। এতে বছর দেড়েক প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে দূরে ছিল বাংলাদেশ। আট বছর পর সেই থিম্পুতে গতকাল (বৃহস্পতিবার) শেখ মোরসালিনের গোলে বাংলাদেশ স্বাগতিক ভুটানকে হারানো খানিকটা স্বস্তিরই। 

ফরিদপুর থেকে ২০১৬ সালেই বিকেএসপিতে ফুটবল ডিসিপ্লিনে ভর্তি হয়েছিলেন মোরসালিন। ঐ বছরেই বাংলাদেশের ভুটান ট্র্যাজেডি। আট বছর আগের স্মৃতি একটু কষ্ট করেই স্মরণ করলেন, ‘বিকেএসপিতে তখন অনেক ছোট ছিলাম। ঐ ম্যাচের ফলাফলের গুরত্ব-আবেদন অতটা বুঝিনি। পেশাদার ফুটবলে পদার্পণের পর থেকে ভুটান ট্র্যাজেডি কথা শুনেছি। এবার থিম্পুতে এসে সবার ইচ্ছে ছিল সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে জয় নিয়ে ফেরা।’

বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে ভালো ফুটবল খেলেনি। একমাত্র শান্ত্বনা জয়। সেই জয়সূচক গোলটি করেছেন মোরসালিন। গত বছর অভিষেক হওয়া মোরসালিন ইতোমধ্যে ১২ ম্যাচে ৫ গোল করেছেন। ম্যাচ প্রতি গোলের হার প্রায় ৫০ শতাংশ। যা বাংলাদেশি ফুটবলারের জন্য বেশ ঈর্ষণীয়। 

গত বছর অভিষেক হওয়া মোরসালিন ইতোমধ্যে ১২ ম্যাচে ৫ গোল করেছেন। ম্যাচ প্রতি গোলের হার প্রায় ৫০ শতাংশ। যা বাংলাদেশি ফুটবলারের জন্য বেশ ঈর্ষণীয়।

জাতীয় দলের জার্সিতে নিয়মিত গোল করলেও ক্লাবের জার্সিতে খেলারই তেমন সুযোগ পান না। ফলে ক্লাবের জার্সিতে গোল সংখ্যাও খুব বেশি নয়। ক্লাব ও জাতীয় দলে গোলের তারতম্যের বিষয়ে মোরসালিনের মন্তব্য, ‘কোচ (জাতীয় দল) আমাকে যে পজিশন খেলাচ্ছে সুযোগ পাচ্ছি, বসুন্ধরা কিংসে আমার পজিশনে বিদেশি খেলে। এজন্য গেম টাইম কম পাই। দশ-বিশ মিনিট খেলার সুযোগ পেলে দুই একটি মিস হয় ফলে গোলও কম হয়।’

জাতীয় দলে নিজের সফলতার জন্য কোচের পাশাপাশি দুই সতীর্থকে বিশেষ কৃতিত্ব দিলেন। রাকিব হোসেন ও ফয়সাল আহমেদ ফাহিম সম্পর্কে বলেন,‘দলের সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। এরপরও রাকিব ভাই ও ফাহিমের ক্রেডিট বেশি। আমার অধিকাংশ গোলই রাকিব ভাইয়ের বাড়ানো বলে। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া বেশ ভালো।’

বয়স মাত্র ২০। এক বছরের মধ্যেই জাতীয় দলে পাঁচ গোল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গোলদাতা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু (১৭)। ফর্ম ও বয়স বিবেচনায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করার অবাধ সুযোগ মোরসালিনের। সামর্থ্য থাকলেও স্বপ্নপূরণে বেশ সংযত এই ফুটবলার, ‘আমি জানি ১৭ গোলের বিষয়। আমার লক্ষ্য আছে অতিক্রম করার। এটা শুধু মুখ দিয়ে বললে হবে না। অনেক চেষ্টা করতে হবে। ইনজুরিমুক্ত থেকে ফর্ম ধরে রাখা পাশাপাশি ভাগ্যের সহায়তাও প্রয়োজন। আমি দোয়া চাই সকলের যেন দেশের হয়ে অনেক দিন খেলতে পারি। খেলতে পারলে আশা করি নিজে গোল করতেও পারব আবার করাতেও পারব।’

মোরসালিনের পাঁচ গোলের মধ্যে দু’টি ভুটান একটি করে আফগানিস্তান, মালদ্বীপ ও লেবাননের বিপক্ষে। দক্ষিণ এশিয়ার গন্ডির বাইরে বাংলাদেশের ফুটবলারদের গোল করার দক্ষতা খুবই কম। সর্বশেষ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ছয় ম্যাচে বাংলাদেশের মাত্র একটি গোল। সেটাও এই মোরসালিনের লেবাননের বিপক্ষে। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের পর এশিয়ান কাপ বাছাইয়েও গোল করতে চান এই ফরোয়ার্ড,‘ সামনে এশিয়ান কাপের বাছাই পর্ব রয়েছে। সেখানেও তুলনামূলক বড় প্রতিপক্ষই থাকবে। ঐ টুর্নামেন্টে গোল করতে চাই।’

দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে এশিয়ার অন্য দেশের সঙ্গে গোল করা একটু কষ্টসাধ্যই। বড় দলের সঙ্গে বাংলাদেশ খুব কম সুযোগই তৈরি করতে পারে। সেই সুযোগের সদ্বব্যবহার করাটাও কঠিন অনেক সময় ফরোয়ার্ডদের। এজন্য নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করছেন মোরসালিন,‘আসলে গোল করছি ভালো লাগছে। ভালোর তো শেষ নেই। আমার শক্তিশালী দিক আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি অন্য দিকে দুর্বল দিকগুলো নিয়েও কাজ করছি।’ 

বক্সের বাইরে থেকে দূর পাল্লার শট মোরসালিনের অন্যতম শক্তির জায়গা। মোহামেডানের জার্সিতে এ রকম গোল করেই মূলত আলোচনায় আসেন ফরিদপুরের এই ফুটবলার। বাংলাদেশের জার্সিতেও এমন গোল আছে। মোরসালিনের ক্লাব বসুন্ধরা কিংস সেটপিসের জন্য এবার বিশেষ কোচ এনেছে। এটা তার ক্যারিয়ারে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন, ‘ক্লাবে সেটপিস কোচ আসায় অনেক উপকার হবে। ফুটবলে এখন সেটপিস থেকেই অনেক গোল হয়। আমার সেটপিস নিয়ে আগ্রহ অনেক। আশা করি সামনে আরো গোল পেতে সহায়ক হবে।’

জাতীয় দলের জার্সি গায়ে গোল করলেও ক্লাবের জার্সিতে আন্তর্জাতিক গোল নেই মোরসালিনের। গত বছর এএফসি কাপে মালদ্বীপ ম্যাচের পর মদ কান্ডে নিষিদ্ধ ছিলেন। সেই নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক খেলায় ফিরেছেন। তাই এই মৌসুমে ক্লাবের জার্সিতেও আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করতে চান মোরসালিন, ‘এখন মনোযোগ জাতীয় দল নিয়েই। আরেকটি ম্যাচ খেলে ক্লাবে ফিরব। অক্টোবরে ক্লাবের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আছে ভুটানেই। প্রথম চেষ্টা থাকবে একাদশে থাকার এরপর গোল করার। জাতীয় দল ভুটানে খেলায় আমাদের ক্লাব ম্যাচও সহায়ক হবে।’

বাংলাদেশের ফুটবলের উঠতি তারকা দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পড়াশোনা ও ফুটবল দু’টোই চালিয়ে যাচ্ছেন। খানিকটা কষ্ট হলেও স্নাতক শেষ করতে বদ্ধ পরিকর মোরসালিন, ‘আমার বিভাগের (ইসলামের ইতিহাস) সবাই হেল্পফুল। আমি যখন খেলার চাপে থাকি তখন বন্ধুরা নোট দিয়ে সহায়তা করে। সত্যিকার অর্থে খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশোনা কষ্ট হলেও আমি উপভোগ করছি। ইতোমধ্যে এক সেমিস্টার ও আরেক সেমিস্টারের মিডটার্ম দিয়েছি।’

এজেড/এফআই