আধা ঘণ্টার এক কালবৈশাখী ঝড়ে বাংলাদেশের ফুটবল ও ফুটবল ফেডারেশনের করুণ চিত্র নিদারুণভাবে ফুটে উঠেছে। গতকাল বিকেলে হওয়া ওই ঝড়ে ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন আহমেদ স্টেডিয়ামের ডাগআউট টেন্ট, প্রেসবক্সের অস্থায়ী তাঁবু সবই উড়ে গেছে। এসব ছাপিয়ে ফুটবলীয় দৃষ্টিতে সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হয়েছে যেটি সেটি হলো, টেবিল দিয়ে মাঠে জমে থাকা পানি সরানো। 

মাঠের খেলা ফুটবল। সেই মাঠের দিকে বাফুফে কখনোই নজর দেয়নি। বৃষ্টির মৌসুমে মাঠে পানি জমলে সেটা নিষ্কাশনের জন্য আধুনিক সাকার মেশিন তো দূরের কথা স্পঞ্জও দেখা যায়নি গতকাল। তাই অগত্যা টেবিল দিয়ে টেনে মাঠ থেকে পানি বের করতে হয়েছে। মাঠ নিয়ে বাফুফের উদাসীনতার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ প্রকৃতিই গতকাল উন্মোচন করে দিয়েছে। 

ফুটবলাররা মাঠে খেললেও মাঠের প্রাণ মূলত গ্রাউন্ডসম্যানরা। নিজেদের নিরলস শ্রম ও মমতা দিয়ে মাঠ তৈরি করেন। চলমান মৌসুমে চারটি ভেন্যুতে খেলা পরিচালনা করলেও বাফুফের স্থায়ী গ্রাউন্ডসম্যান এক চান্দুই। যিনি মূলত একেবারে মাঠকর্মী। হাতে-কলমে কাজ করতে করতে শিখছেন। একাই ছুটে বেড়ান এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে।

চান্দুর অবস্থা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। চান্দুর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য, তার সঙ্গে ফেডারেশনের স্থায়ী আর কোনো মাঠকর্মী নেই। আধুনিক তো নয়ই প্রয়োজনীয় অনেক সরঞ্জামও নেই। মাঠের সীমানা ঠিক হয় মান্ধাতা আমলের মতো টেপ ফিতা মেতে। হাফ লাইন, বক্সের জন্য রংয়ের জন্য নেই বিশেষ কোনো মেশিন চুনের বালতিই ভরসা।

চান্দুর অবস্থা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার।

ফিফা-এএফসি’র অর্থায়নে মাথাভারী প্রশাসন ফুটবল ফেডারেশনের। সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান অর্থ কমর্কতার সম্মানী আট লাখ টাকার কাছাকাছি। বিভিন্ন বিভাগের ম্যানেজারদের বেতনও লাখের ওপর। এত পেশাদার লোকবল অথচ ফিফার নির্দেশনা অনুসারে অর্থ ব্যয় না করায় নিষেধাজ্ঞার ঘটনাও ঘটেছে। আবার এত পেশাদার লোক রেখেও অব্যবস্থাপনার ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। অথচ কিছু হলেই এই পেশাদার লোকরা ফুটবলসংশ্লিষ্টদের ফিফা-এএফসি’র বাণী শোনান। মাঠ কর্মী নেই অথচ কিছু সময় পরপর শুধু মোটা অঙ্কের এক্সিকিউটিভ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। 

কাজী সালাউদ্দিনের আমলে গ্রাউন্ডস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সিনিয়র সংগঠক ফজলুর রহমান বাবুল। মাঠ নিয়ে তিনি অনেক সংগ্রাম-প্রতিবাদ করেছেন। বর্ষীয়ান এই সংগঠক এখন অনেকটাই বীতশ্রদ্ধ, ‘মাঠের ব্যাপারে নীতি-নির্ধারকদের কোনো খেয়ালই নেই। অন্য খাতে অনেক টাকা ব্যয় করলেও মাঠের জন্য বরাদ্দ করতে যেন শত আর্থিক অনটন। মাঠকে গুরুত্ব না দিলে ফুটবলের মান উন্নয়ন কখনোই সম্ভব না।’

তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে বাফুফের নতুন কমিটি আধুনিকতা ও নতুনত্বের বুলি আওড়াচ্ছে। নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস হতে চলল এখনো নেই কোনো গ্রাউন্ডস কমিটি। সভাপতি তাবিথ আউয়ালের অন্যতম আস্থাভাজন সহ-সভাপতি ফাহাদ করিম কয়েক দিন জাতীয় স্টেডিয়াম পরির্দশনের পর জোর গলায় বলেছিলেন দু’এক দিনের মধ্যে গ্রাউন্ডস কমিটি ঘোষণা হবে।

ফাহাদের এমন মন্তব্যের পর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও নেই কোনো প্রতিফলন। তাবিথ আউয়ালের নতুন কমিটি প্রবাসী ফুটবলারদের দিকে যত মনোযোগী ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে ঠিক ততটাই উদাসীন। এবারের মৌসুম শুরু হয়েছে অপ্রস্তুত মাঠে। জাতীয় দলের জন্য ঘরোয়া লিগ দেড় মাস বন্ধ থাকলেও ফেডারেশন মাঠ নিয়ে কোনো কাজ করেনি। তাবিথ আউয়াল গ্রাউন্ডস কমিটি যেমন করেননি তেমনি এখনো নেই গুরুত্বপূর্ণ রেফারিজ কমিটি, মৌসুম শেষ হতে চললেও এখনো ডিসিপ্লিনারি কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হয়নি। 

কালবৈশাখীর কবলে পড়ে স্থগিত হয়ে গেছে ফেডারেশন কাপের ফাইনাল।

ঝড়ের জন্য গতকাল আবাহনী ও কিংসের ফাইনাল অসমাপ্ত ছিল। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ফুটবল হলেও ঢাকা ও সিলেট ছাড়া অন্য কোনো জেলা পর্যায়ে রাতের আলোয় জাতীয়-আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ নেই। এটা সরকারের ফুটবলের প্রতি যেমন উদাসীনতা তেমনি বাফুফে কর্তাদের ব্যর্থতা জেলা পর্যায়ে স্টেডিয়ামগুলো মান উন্নয়ন সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে ব্যর্থ। কারণ বাফুফের বড় পদগুলোতে যারা বসেন তারা সবাই সরকারের আস্থাভাজনই থাকেন। নিজেদের পদ নিয়ে তারা যতটা ভাবেন ফুটবলের মান উন্নয়নে ততটা ভাবেন না সেটা কালকের ঝড় আবারো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।

কাজী সালাউদ্দিন বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসানকে লিগ কমিটির চেয়ারম্যান করে সমালোচনার মধ্যে পড়েছিলেন। নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়ালও সালাউদ্দিনের পথে হেঁটেছেন। বাইলজ অনুযায়ী, খেলা অসমাপ্ত থাকলে পুনরায় খেলা শুরুর সময়-দিনক্ষণের সিদ্ধান্ত নেবে পেশাদার লিগ কমিটি। সেখানেও রয়েছে বড় স্বার্থের সংঘাত অংশ। চেয়ারম্যান যখন একজন ক্লাবের সভাপতি হতে পারেন সেখানে ফেডারেশনের একজন নির্বাহী সদস্য ক্লাবের ম্যানেজার পরিচয়ে ডাগ আউটে রেফারির সিদ্ধান্তের নাখোশ ও বিরূপ মনোভাব পোষণ করা আর কতটুকুই বা অস্বাভাবিক!

এজেড/এফআই