‘কোচ হিসেবেও সেরা হতে চাই’
দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান। ফুটবলের সাফল্যই ছিল ক্লাবটির জনপ্রিয়তার ভিত্তি। সেই ফুটবলে ২০০২ সালের পর আর লিগ শিরোপা পায়নি মতিঝিলের ক্লাবটি। গতকাল কুমিল্লায় ফর্টিজের কাছে আবাহনীর হারের পর পেশাদার ফুটবল লিগে প্রথম বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেল মোহামেডান।
মোহামেডানের এই সাফল্যের অন্যতম কারিগর কোচ আলফাজ আহমেদ। যিনি ফুটবলার হিসেবেও মোহামেডানের অসংখ্য শিরোপার স্বাক্ষী। মোহামেডানের চ্যাম্পিয়ন কোচ আলফাজ আহমেদ ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : ২২ বছর পর মোহামেডান ঘরোয়া ফুটবলে লিগ চ্যাম্পিয়ন। ঐতিহ্যবাহী একটি ক্লাবের দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার অবসান হলো আপনার কোচিংয়ে...
আলফাজ : আল্লাহ’র রহমতে মোহামেডানের দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে আমাদের টিম স্পিরিটের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রত্যেক খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ, কর্মকর্তা এবং সাবেক ফুটবলারদের মধ্যে একতা ছিল। এর বহিঃপ্রকাশ মাঠে ঘটেছে এবং সাফল্য এসেছে।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : ২০০২ সালে সর্বশেষ লিগ চ্যাম্পিয়ন দলে আপনি ছিলেন। এবার কোচ হিসেবেও শিরোপা পেলেন। দুই ভূমিকার অনুভূতি কেমন?
আলফাজ : দুই নয় তিন ভূমিকায় আমার মোহামেডানের শিরোপা জেতার অভিজ্ঞতা হলো। খেলোয়াড়, অধিনায়ক ও কোচ। তিনটা তিন ধরনের ভূমিকা। খেলোয়াড় হিসেবে শুধু নিজের খেলা ও টিমমেটদের বিষয়ে ভাবতাম। আর ফুটবলে শিরোপার মূল আনন্দটাই করে খেলোয়াড়রা। সেই অনুভূতি অবশ্যই বেশি। অধিনায়কত্ব একটু বাড়তি দায়িত্ব। অধিনায়ক পজিশনটা কোচ-ম্যানেজম্যান্টের সঙ্গে খেলোয়াড়দের সেতুবন্ধনকারী। তখন নিজের খেলার পাশাপাশি দলের সবার অধিকার, মর্যাদার বিষয়ও দেখতে হয়েছিল। কোচ হিসেবে তো শুধু নিজের দল নয় প্রতিপক্ষ নিয়ে পরিকল্পনা, পারিপাশ্বিক অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। খেলোয়াড় হিসেবে বেশ কয়েকবার লিগ চ্যাম্পিয়নের স্বাদ পেলেও কোচ হিসেবে এই প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়ন হলাম। আমার কোচিংয়ে মোহামেডান প্রথম পেশাদার লিগ চ্যাম্পিয়ন এটার তৃপ্তি অন্যরকম।
ঢাকা পোস্ট : আপনার খেলোয়াড়ী জীবনে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন মানেই ঢাকা জুড়ে উৎসবের আবহ। কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মোহামেডানের সেই পুরনো আবহ অনেকটাই কম। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের এই বিবর্তন কিভাবে দেখছেন?
আলফাজ : অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাঠে খেলার পরই শিরোপা বা চ্যাম্পিয়ন উদযাপন হয়েছে। এবার একটু ব্যতিক্রম আবাহনী হেরে যাওয়ায় ঘরে বসেই চ্যাম্পিয়ন। মোহামেডান অনেক দিন শিরোপা পায়নি। মাঝে অনেক সংকটপূর্ণ সময় ছিল। ক্লাব সভাপতি আমাদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। আমরা কিন্তু দেড় বছর আগে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। গত বছর তিন প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ ছিলাম। এবার লিগে চ্যাম্পিয়ন হলাম। এখন এই ধারাবাহিকতা রাখতে পারলে মোহামেডান ধীরে ধীরে আগের সেই অবস্থানে ফিরে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। মোহামেডানের সমর্থকদের ধন্যবাদ জানাই মাঝে মোহামেডানের শিরোপাখরা থাকলেও তারা ক্লাবকে সমর্থন ও উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন। এই সাফল্যে সমর্থকদেরও অবদান অনেক কারণ ফুটবলে সমর্থকরাই প্রাণ।
ঢাকা পোস্ট : লিগে মোহামেডান এখন পর্যন্ত ১৫ ম্যাচ খেলেছে। মাত্র একটি হার ও দুই ড্র। ১২ ম্যাচই জিতেছে। লিগে ধারাবাহিক দলটি ফেডারেশন কাপে পরের রাউন্ডেই যেতে পারল না।
আলফাজ : মৌসুমের প্রথম শিরোপাই মোহামেডানের হতে পারত। চ্যালেঞ্জ কাপে আমরা শুরুটাও ভালো করেছিলাম। স্মোক ফ্লেয়ার খেলার ছন্দ নষ্ট করে দেয়। এরপর ম্যাচ হাতছাড়া হয়। লিগের শুরুটা আমাদের ভালোই হয়েছিল সেটা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলাম। ফেডারেশন কাপে আমাদের দু’টি বাজে দিন গেছে ফলে টুর্নামেন্টে আর ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। আরেকটি বিষয় গত মৌসুমের তুলনায় আমাদের দলীয় শক্তি কিন্তু খানিকটা কম এবার। দুই-তিন প্রতিযোগিতায় সমান পারফরম্যান্স করতে হলে ব্যাক আপ খেলোয়াড়ও অনেক প্রয়োজন। সেখানে আমাদের কিছুটা ঘাটতি ছিল। যখন দেখলাম ফেডারেশন কাপ আর নেই লিগের অবস্থান ভালো তখন পুরো মনোযোগই লিগে ছিল।
ঢাকা পোস্ট : আপনি বললেন গতবারের চেয়ে দলীয় শক্তি আপনার কম ছিল। এরপরও কাগজে কলমে কিংস আপনাদের চেয়ে শক্তিশালী এবং আবাহনী প্রথম লেগে বিদেশি ছাড়া হলেও দেশি অনেক তারকা ফুটবলারই রয়েছেন। আবাহনী-কিংস দুই লেগ মিলিয়ে ৪ ম্যাচে ১২ পয়েন্টের মধ্যে ১০ পয়েন্টই নিয়েছেন। সেটার রহস্য কি?
আলফাজ : শুধু এই মৌসুম নয় আমরা কিন্তু আবাহনী ও কিংসকে গত মৌসুমেও হারিয়েছি। এই দুই দলের বিপক্ষে কৌশলগুলো খেলোয়াড়রা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। পাশাপাশি কোচিং স্টাফ,কর্মকর্তারা খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে অনেক উজ্জ্বীবিত করেন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে। যেটাও বেশ বড় প্রভাবক।
ঢাকা পোস্ট : সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলে প্রবাসী ফুটবলার নিয়ে আপনার মন্তব্য সমর্থক ও অনেক ফুটবলপ্রেমীরা কড়া সমালোচনা করেছিলেন। সেই সময় বেশ মানসিক ও সামাজিক চাপের মধ্যে ছিলেন। সেই চাপ পেরিয়ে কোচিংয়ে মনোযোগ রাখা এবং দ্বিতীয় লেগে পরপর দুই ম্যাচে কিংস-আবাহনীর মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ কেমন ছিল?
আলফাজ : আসলে সেটা কাটিয়ে উঠা অনেক কষ্টকরই ছিল। তখন কোচিং ও কাজে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ভিন্ন মত কিংবা সমালোচনা সব বিষয়ে থাকবেই।
ঢাকা পোস্ট : ক্লাবের অনুশীলন মাঠ সংকট, খেলোয়াড়দের বেতন বকেয়া সব এত প্রতিবন্ধকতা ছাপিয়ে কিভাবে লিগে সফল হলেন?
আলফাজ : এই সকল সংকট সমাধানে টিম ম্যানেজারের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি পেয়েছি। টাকা বা যে কোনো সমস্যা যখন হয়েছে তিনি দ্রুত সমাধান বা আশ্বাসের চেষ্টা করেছেন। খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফদের চাহিদা অনেক সময় মেটেনি কিন্তু তারা অনুভব করতে পেরেছে আসলেই ক্লাব তাদের জন্য দিতে চায় কিন্তু পারছে না। এজন্য তারাও ত্যাগ করেছে।
ঢাকা পোস্ট : খেলোয়াড় হিসেবে আপনি দেশের অন্যতম কিংবদন্তীদের একজন। আপনার গোলে ৯৯ সাফ গেমসে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। ’০৩ সাফ ও ১৯৯৫ মিয়ানমার চার জাতি শিরোপার আপনি অন্যতম অংশীদার। বাংলাদেশের একমাত্র ফুটবলার যিনি এশিয়ার প্লেয়ার অফ দ্য মান্থ হয়েছিলেন। আপনি কোচিং করাচ্ছেন প্রায় এক দশক। এখনও আপনার খেলোয়াড় পরিচয়টাই ক্রীড়াঙ্গনে বড়। কোচ আলফাজ কি খেলোয়াড় আফলাজকে স্পর্শ করতে পারবে?
আলফাজ: যখন খেলোয়াড় ছিলাম তখন নিজের সেরাটাই দিয়েছি। পারফরম্যান্স ও ফলাফলের জন্য মানুষ এখনো স্মরণ করে। সবার প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। কোচ হিসেবেও নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি যখন যে কাজই করি। সেটা শতভাগ মনোযোগ ও নিবেদন দিয়ে করি। কোচিং এখন আমার পেশা। মোহামেডানের হয়ে ইতোমধ্যে ফেডারেশন কাপের পর লিগ চ্যাম্পিয়ন হলাম। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ২০২৩ সালে বর্ষসেরা কোচের স্বীকৃতি দিয়েছিল। খেলোয়াড় হিসেবেও আমি এই স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। কোচের সফলতা বজায় রেখে কোচ হিসেবেও সেরা হতে চাই।
ঢাকা পোস্ট : বর্তমান সময়ে কোচিং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও ট্যাকটিস নির্ভর। দেশের আরো দুই তিন জন শীর্ষ কোচদের চেয়ে আপনি এই চর্চায় খানিকটা পিছিয়ে বলে ধারণা ফুটবলসংশ্লিষ্টদের। দেশের শীর্ষ স্তরের লিগে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করিয়ে এখন আপনি কোচ হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত মনে করছেন কি?
আলফাজ: কোচিংয়ে কারো খাটো করে দেখার কেউ নেই। মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বলেই আমার সফলতা ও এত আলোচনা হচ্ছে। চ্যাম্পিয়ন না হলে অন্য রকম আলোচনাও হতো। কোচ ভেদে কৌশল, পরিকল্পনা ভিন্নতা থাকে তবে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ও ফলাফলেই কোচকে পূর্ণতা প্রদান করে।
ঢাকা পোস্ট : মোহামেডান লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় এএফসি কাপে খেলার সুযোগ রয়েছে। ক্লাব লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর এএফসিতে যদি মোহামেডান খেলে তখন অন্যতম শর্ত প্রো লাইসেন্স কোর্স। আপনার সেখানে এ লাইসেন্স।
আলফাজ: এখনো লিগের তিন ম্যাচ রয়েছে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় সমর্থকদের প্রত্যাশা আরও বেড়েছে। এই তিন ম্যাচ নিয়েই এখন ভাবনা। এএফসি টুর্নামেন্টে লাইসেন্সিং ও অংশগ্রহণের বিষয়টি সম্পূর্ণরুপে ক্লাব কর্তৃপক্ষের। তারা যদি প্রয়োজন মনে করে অবশ্যই প্রো লাইসেন্স কোচ নেবে। এটা আমি স্বাগতই জানাব।
এজেড/এফআই