তখন অর্থবিত্তের ছড়াছড়ি কিংবা গণমাধ্যমের এত বাড়াবাড়ি প্রচার ছিল না। ফুটবল খেলাকে মনে করা হতো বিনোদন ও সামাজিক সংহতির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এমনকি বিশ্বের অনেক নামকরা ফুটবল ক্লাব শ্রমিকদের চাঁদা বা অনুদানের টাকায় গড়ে উঠেছিল। শ্রমজীবী মানুষের অবসর কাটত সেসব ক্লাবকে ঘিরে। যুগ বদলেছে, সর্বত্র ছোঁয়া লেগেছে আধুনিকতার। শ্রমিকদের শ্রম-ঘামে গড়া সেসব ক্লাব এখন বাজি লড়ছে বিলিয়ন ডলারের ট্রান্সফার মার্কেটে।

ইংল্যান্ডকে বলা হয় ফুটবলের আধুনিক জন্মভূমি। যেখানে বর্তমানে খেলছে এমন ক্লাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন শেফিল্ড ইউনাইটেডের যাত্রা শুরু হয় ১৮৫৭ সালে। ক্লাবটির উত্থানের গল্পটা মজার। নাথানিয়েল ক্রেসউইক ও উইলিয়াম প্রেস্ট নামে দুই বন্ধু শীতকালীন অবসর কাটানোর জন্য এই শেফিল্ড ফুটবল দল চালুর উদ্যোগ নেন। কারণ ওই সময়ে তাদের প্রধান পছন্দ ক্রিকেট খেলা বন্ধ থাকত। বর্তমানে শেফিল্ড এফসি নামে পরিচিত ক্লাবটিকে সবচেয়ে প্রাচীন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে ফিফা।

নামকরা ক্লাবগুলোর উত্থানেও আছে শ্রমিকদের অবদান। ১৮৭৮ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার এন্ড ইয়র্কশায়ার রেলওয়ের শ্রমিকরা গড়ে তোলেন ‘নিউটন হিথ এলওয়াইআর ইউনাইটেড’ নামে একটি ক্লাব। রেলওয়ে শ্রমিকদের চাঁদা ও ডিপো থেকে অনুদানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ক্লাবটি হচ্ছে বর্তমান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তারও চার বছর আগে বার্মিংহামের স্থানীয় কারখানার শ্রমিকরা নিজেদের অর্থায়নে গড়ে তোলেন অ্যাস্টন ভিলা। এভাবে মেকানিক ও লোহার কারিগরদের মাধ্যমে ‘আর্সেনাল’ ও শিপইয়ার্ড কর্মচারীরা ‘ওয়েস্ট হ্যাম’ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন।

এভারটনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থেকে শুরু হয় লিভারপুলের যাত্রা, ব্যবসায়ীদের হাতে মালিকানা থাকলেও শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের অনুদান ছিল চালিকাশক্তি  

কেবল ইংল্যান্ড–ই নয়, বর্তমান স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনা; ইতালির ইন্টার ও এসি মিলান, জুভেন্তাস; ব্রাজিলের করিন্থিয়ান্স, আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্সের মতো ইতিহাসসমৃদ্ধ ক্লাবের শুরুর গল্পটাও একই। বাণিজ্যিক মালিকানায় যাওয়ার আগে এসব ক্লাবের আয় ছিল শ্রমিকদের চাঁদা ও টিকিটের দামনির্ভর। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে– কেন হঠাৎ ফুটবল ক্লাবের ইতিহাস বই উল্টাতে শুরু করেছি। এই আলোচনার লক্ষ্য– ফুটবল ক্লাবের আদি ও বর্তমানের মাঝে তুলনামূলক ধারণা পাওয়া। বিনোদনের উৎস হিসেবে জন্ম নেওয়া ক্লাবগুলো এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাতারে। খেলোয়াড় বিকিকিনি, বিজ্ঞাপনী আয়, স্পন্সর ও টিভি সত্ত্ব মিলিয়ে একেকটি ক্লাবের বাজারমূল্য বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

২০২৫-২৬ ট্রান্সফার মার্কেটে ইংলিশ ঝড়

প্রতি বছরই ক্লাব ফুটবলের মৌসুম শুরুর আগে পুরো বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে দলবদলের উইন্ডো। কে কোন ক্লাবে কত বেশি পারিশ্রমিকে যোগ দিচ্ছে, ক্লাবগুলোর অর্থলগ্নির পরিমাণ, একেকজন খেলোয়াড়ের জন্য কয়েকটি ক্লাবের টানাহেঁচড়া রূপ মিলিয়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে। এবারের গ্রীষ্মে ছিল দুটি ট্রান্সফার উইন্ডো। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের কারণে নিবন্ধনের অতিরিক্ত সময় (১ জুন থেকে ১০ জুন) অনুমোদন দিয়েছিল ফিফা। এরপর গত সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে দ্বিতীয় উইন্ডো শেষ হয়েছে।

২০২৫-২৫ ট্রান্সফারে ইতিহাস গড়েছে ইংলিশ চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল। অনেক নাটকীয়তার পর তারা সুইডিশ স্ট্রাইকার আলেক্সান্ডার ইসাককে বাজার বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে নিউক্যাসল ইউনাইটেড থেকে দলে ভিড়িয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের খরচের অঙ্কটাও চোখ ধাঁধানো। ইসাককে আনতে অ্যানফিল্ডের ক্লাবটি ইংলিশ লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১২৫ মিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ২০৩৪ কোটি টাকা) ব্যয় করেছে। এর আগে ফ্লোরিয়ার ভির্টজের জন্য তারা ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করে। সবমিলিয়ে আর্নে স্লটের দল খেলোয়াড় কিনেছে ৪১৭ মিলিয়ন পাউন্ডে (৬৮৩৩ কোটি টাকা)।

টানাটানি ও মন কষাকষির পর আলেক্সান্ডার ইসাককে রেকর্ডমূল্যে নিউক্যাসল থেকে কিনেছে লিভারপুল

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ফুটবল লিগের খ্যাতি ছিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের। একের পর এক অবিশ্বাস্য চুক্তির বদৌলতে এবার তাদের ট্রান্সফার উইন্ডোর খরচ প্রথমবারের মতো তিন বিলিয়ন পাউন্ডে পৌঁছেছে। এর আগে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর এক মৌসুমের দলবদলে সর্বোচ্চ ব্যয় ছিল ২০২২-২৩ মৌসুমে, ২৭০ কোটি পাউন্ড। সেটিকে ছাড়িয়ে এবার ইংলিশ লিগ ইতিহাসের পাতায় নাম তুলেছে। অথচ এখনও জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডো বাকি। 

আর্থিক সক্ষমতার বিচারে প্রিমিয়ার লিগ বাকি চার শীর্ষ ইউরোপীয় লিগের (লা লিগা, বুন্দেসলিগা, সিরি আ, লিগ ওয়ান) চেয়ে আগে থেকেই এগিয়ে। এবারও তারই প্রমাণ মিলল। তারা একাই ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ ক্লাবের মোট নেট ব্যয়ের ৫১ শতাংশ খেলোয়াড়দের জন্য দিয়েছে। ডেলয়েটের তথ্য অনুযায়ী, অন্য চার লিগের গড় মোট ব্যয় যেখানে ৯ মিলিয়ন ইউরো, সেখানে ইংলিশ লিগের ক্লাবগুলো এগিয়ে গেছে যোজন যোজন ব্যবধানে।

বিশ্বজুড়ে আর্থিক পরিষেবা, অডিট, কর ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘ডেলয়েট’ স্পোর্টস বিজনেস গ্রুপের প্রধান অংশীদার টিম ব্রিজ প্রিমিয়ার লিগের এই বাণিজ্যিক দাপট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তার মতে– ‘দলবদল বাজারে খরচের দিক থেকে চার বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো রেকর্ড ভাঙলো প্রিমিয়ার লিগ। যা একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে– অন্যান্য ইউরোপীয় লিগের ব্যয় কমলেও, ইংলিশ ক্লাবগুলো তাদের মাঠের পারফরম্যান্সের জন্য বিনিয়োগ বন্ধ করার কথা ভাবছে না। বিনিয়োগের এখনও তাদের প্রবল আগ্রহ। তবে আর্থিক স্থিতিশীলতা সব সময় ব্যবসায়ের মূল হওয়া উচিত, যা ক্লাবের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য নিশ্চিত করবে।’

প্রিমিয়ার লিগের পর ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় স্তরের চ্যাম্পিয়নশিপও মিলিতভাবে ২৪০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছে। যা গত মৌসুমের চেয়ে ৯৫ মিলিয়ন পাউন্ড বেশি। ডেলয়েটের তথ্যানুযায়ী, প্রিমিয়ার লিগে টিভির চুক্তি থেকে আয়ের কারণে মধ্যম মানের ক্লাবগুলোরও বিশাল আয় হচ্ছে। শেফিল্ড হ্যালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল ফাইন্যান্স বিশেষজ্ঞ ড্যান প্লামলে বলেন, ‘এই গ্রীষ্মে আমরা প্রিমিয়ার লিগের বিশ্ব ফুটবলের ওপর আর্থিক প্রভাব লক্ষ্য করেছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রচার আয়ের কারণে তারা অন্য লিগের তুলনায় এক ধাপ এগিয়ে আছে।’

ইসাকের পর ট্রান্সফার মূল্যে এরপরই অবস্থান ফ্লোরিয়ান ভির্টজ (১১৬.৫ মিলিয়ন ইউরো), হুগো একিতিকে (৭৯ মিলিয়ন ইউরো) ও বেঞ্জামিন সেসকোর (৭৩. ৫ মিলিয়ন ইউরো)

এবারের ট্রান্সফার মার্কেটে প্রিমিয়ার লিগের প্রভাব কতটা তা ‘ট্রান্সফারমার্কেট’ ওয়েবসাইটের তথ্যে চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়। এবার সর্বোচ্চ ব্যয় করা শীর্ষ ১০ ক্লাবের মধ্যে প্রিমিয়ার লিগেরই ৯টি। মাঝে নবম দল হিসেবে অবশ্য চমক দিয়েছে জার্মান বুন্দেসলিগার ক্লাব বায়ার লেভারকুসেন। তালিকায় অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ ও রিয়াল মাদ্রিদের অবস্থান ১১ ও ১২ নম্বরে। এ ছাড়া ইতালির এসি মিলান ত্রয়োদশ ও জুভেন্তাস ১৮ নম্বরে রয়েছে।

ট্রান্সফার মার্কেটে ক্লাবভিত্তিক আয়-ব্যয়ের চিত্র (ইউরোর হিসাবে)

ক্লাব ব্যয় খেলোয়াড় ক্রয় আয়  খেলোয়াড় বিক্রি
লিভারপুল ৪৮২.৯০ মিলিয়ন ১৫ ২১৯.৫০ মিলিয়ন  ১২
চেলসি ৩২৮.১৫ মিলিয়ন ২৬ ৩৩২.২৫ মিলিয়ন ২৩
আর্সেনাল ২৯৩.৫০ মিলিয়ন ১৫ ১০.৩০ মিলিয়ন ১৪
নিউক্যাসল ২৮৮.৮৫ মিলিয়ন ১২ ১৭৬ মিলিয়ন ১১
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ২৫০.৭৫ মিলিয়ন ১৩ ৭৪.২০ মিলিয়ন ১২
নটিংহ্যাম ফরেস্ট ২৩৬.৯০ মিলিয়ন ২১ ১২৪.৪০ মিলিয়ন  ১৮
টটেনহ্যাম ২১০.৬০ মিলিয়ন ১৫ ৪১.৫০ মিলিয়ন ১৫
ম্যানচেস্টার সিটি ২০৬.৯০ মিলিয়ন ১৬ ৭০.৫০ মিলিয়ন ১৫
বায়ার লেভারকুসেন ১৯৮.১৫ মিলিয়ন ২২ ২২৯.৫০ মিলিয়ন  ২০
সান্ডারল্যান্ড ১৮৭.৯০ মিলিয়ন ২৫ ৫১ মিলিয়ন ১৫
অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ ১৭৬ মিলিয়ন ১৬ ৬৮ মিলিয়ন ১৪
রিয়াল মাদ্রিদ ১৬৭.৫০ মিলিয়ন ২ মিলিয়ন
এসি মিলান ১৬৪ মিলিয়ন ২৫ ১৬৯.৩০ মিলিয়ন ২৭
গালাতাসারে ১৪৮.২৭ মিলিয়ন ২৪ ১৬.৪৫ মিলিয়ন ২২
ওয়েস্ট হ্যাম ১৪৩.৮০ মিলিয়ন ২১ ৮৯.৫০ মিলিয়ন ১৭

এএইচএস