ঘরোয়া ফুটবলে ২০২৫-২৬ ফুটবল মৌসুমে ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত ছিল। ২০২৪-২৫ মৌসুমে উজবেক ফুটবলারের প্রাপ্য পাওনা পরিশোধ করেনি ফকিরেরপুল। ফিফায় আবেদনের প্রেক্ষিত ফকিরেরপুলের ওপর ট্রান্সফার নিষেধাজ্ঞা হয়। ফুটবলারের পাওনা পরিশোধ করায় প্রিমিয়ার লিগ খেলছে ফকিরেরপুল। 

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস। ২০২৫-২৬ মৌসুম শুরু হওয়ার পর কিংসের ওপর দলবদলের নিষেধাজ্ঞা আসে। কারণ গত মৌসুমে কিংসের রোমানিয়ান কোচ ভ্যালেরি তিতে চুক্তি অনুযায়ী অর্থ না পাওয়ায় ফিফার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। 

বিদেশি ফুটবলার, কোচিং স্টাফ ফিফায় আবেদন করে তাদের প্রাপ্য পাওনা বুঝে নিচ্ছে। অথচ প্রতি মৌসুমেই বাংলাদেশের ফুটবলার, কোচরা চুক্তিকৃত অর্থ পান না। এরপরও খেলে যান ও কোচিং করান তারা। গতকাল ফিনল্যান্ড প্রবাসী ফুটবলার তারিক কাজী বসুন্ধরা কিংস থেকে বকেয়া বেতন না পাওয়ায় চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে ঘরোয়া ফুটবলে দেশীয় ফুটবলারদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত না হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। 

ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির কোনো ভূমিকা নেই

ফুটবলারদের অধিকার আদায়ের জন্য আশির দশকের শেষ দিকে ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি গঠন হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে এটি এখন শুধুই শূন্য অফিস সর্বস্ব সংগঠন। ফুটবলারদের অধিকার নিয়ে কোনো কাজেই দেখা যায় না। এক যুগের বেশি সময় খেলোয়ার কল্যাণ সমিতির সভাপতি সাবেক জাতীয় ফুটবলার ইকবাল হোসেন। তিনি আবার বাফুফে সদস্য হয়েছেন এক যুগ আগেই। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তিনিই সমিতির সভাপতি। ফুটবলারদের প্রাপ্য অর্থ না পাওয়া নিয়ে সমিতির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফুটবলাররা আমাদের লিখিত বা মৌখিক কোনোভাবেই জানায় না। ফুটবলাররা জানালে সমিতির পক্ষ থেকে ভূমিকা রাখা যায়। না জানালে আমাদের কিছু করার থাকে না।’

ফুটবলার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও সমিতির দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ দেশের আরেক জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটাদের কল্যাণের জন্য সংগঠন কোয়াব প্রতিনিয়তই নিরাপত্তা, আর্থিক নানা বিষয়ে বিবৃতি দেয় এবং বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে। 

ফুটবলারদের অধিকার আদায়ের জন্য আশির দশকের শেষ দিকে ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি গঠন হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে এটি এখন শুধুই শূন্য অফিস সর্বস্ব সংগঠন। ফুটবলারদের অধিকার নিয়ে কোনো কাজেই দেখা যায় না।

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি সমিতির নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করে বলেন, ‘সমিতির কোনো কর্মকাণ্ডই নেই। ফলে ফুটবলাররা তাদের কাছে যাওয়ার কোনো ক্ষেত্রই নেই। সমিতির কার্যক্রম থাকলে তখন অবশ্যই ফুটবলাররা তাদের কাছে যেত।’ বাস্তবিক খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি নেতৃত্বের সংকটে। এ নিয়ে সভাপতি ইকবাল বলেন, ‘বেশ কয়েকবার বর্তমান ও সদ্য সাবেক ফুটবলারদের ডাকা হয়েছে সংগঠনের নেতৃত্বে আসার জন্য। মিটিংয়ে ৮-১০ জনের বেশি আসে না। কেউ দায়িত্বও নিতে চায় না।’

বাফুফের প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটির ভূমিকা ও ক্ষমতা কতটুকু?

খেলোয়াড়-কোচ-ক্লাবের দ্বন্দ্ব বা অমীমাংসিত বিষয়গুলো প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটি সমাধান করে। বাফুফেরও এই কমিটি রয়েছে। প্রায় দুই দশক এই কমিটির চেয়ারম্যান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক সচিব আক্তার হোসেন খান। দেশীয় কোচ-ফুটবলাররা দেনা-পাওনার বিষয়ে ফেডারেশনে খুব কমই আবেদন করে। এর কারণ সম্পর্কে তার মত, ‘অনেক সময় আবেদনের পর আমরা একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছি। পরবর্তীতে খেলোয়াড়-ক্লাব মিলে সমঝোতা করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে খেলোয়াড়-কোচরাই নিজেরাই আলোচনা করে ঠিক করে নেয়। ফলে আমাদের কাছে আর সেভাবে আসে না।’

বিশ্ব ফুটবলে ফুটবলার-কোচের প্রাপ্য অর্থ অমীমাংসিত থাকলে ক্লাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ফিফা। আবার ফুটবলারও চুক্তি পূরণ না করলে তারও খেলার ওপর বাধা আসে। বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত ও আইন প্রয়োগ নিয়ে প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, ‘ফিফা আইন করে সার্বজনীন এর প্রয়োগও সেই রকম। বাফুফের প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটিও সেই রকম অনুসরণ করে আইন রয়েছে। তবে বাংলাদেশর প্রেক্ষাপটে কঠোর বাস্তবায়ন একটু কমই। আর্থিক জরিমানা, সতর্কতেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।’

বাংলাদেশে খেলতে আসা বিদেশি ফুটবলার-কোচরা ক্লাব থেকে প্রাপ্য অর্থ না পেলে সরাসরি ফিফায় অভিযোগ করে। যেহেতু বাফুফের অধীনে খেলা ফলে বাফুফের প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটির কাছে প্রথমে আবেদন করা যৌক্তিক। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে সকল আবেদনই সরাসরি ফিফায় করেছেন বিদেশি ফুটবলাররা। এমনটা হওয়ার কারণ সম্পর্কে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আশরাফুল ইসলাম রানা বলেন, ‘আমাদের ফুটবলাররাই চুক্তি অনুযায়ী ঠিক মতো অর্থ পান না। কয়েক মৌসুম বাংলাদেশে খেলা বিদেশিরা এটা জানে। আবার যারা নতুন তারাও এসে খোঁজ খবর পেয়ে যায়। দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য তারা সরাসরি ফিফার দ্বারস্থ হয়।’

অধিকার আদায়ে ফুটবলারদের ‘অজ্ঞতা ও অনীহা’

পেশাদার ফুটবলে ক্লাবের সঙ্গে ফুটবলারদের চুক্তি হয়। সেই চুক্তির এক কপি ফুটবলারের কাছে, আরেক কপি ক্লাবে আরেক কপি ফেডারেশনে থাকে। এই চুক্তিপত্র নিয়ে দেশের অধিকাংশ ফুটবলারই উদাসীন। ফলে ক্লাব তাদের প্রাপ্য অর্থ না দিলেও কিছু করার থাকে না মনে করেন সাবেক জাতীয় অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি, ‘আমাদের অনেক ফুটবলারের কাছে নিজের চুক্তিপত্র থাকে না। যখন চুক্তিপত্র থাকে না তখন চুক্তি ভঙ্গ কিংবা নিজের অধিকার হারালেও কিছু করার থাকে না। আবার অনেকে চুক্তির অঙ্ক কত সেটাও জানে না। ক্লাব কর্মকর্তারা অনুরোধে বা চাপে স্বাক্ষর করে।’

ফুটবলাররা শোষিত ও অধিকার হরণের পরও থাকে নিশ্চুপ। এর কারণ সম্পর্কে আরেক সাবেক জাতীয় অধিনায়ক ও গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানা বলেন,‘শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলারদের জন্য ঘুরে ফিরে ৫-৬ টা ক্লাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। এক মৌসুমে প্রাপ্য অর্থের জন্য ফেডারেশনে আবেদন করলে এজন্য যদি পরের মৌসুমে দল না পায় বা ক্লাব না নিতে চায় এভেবেও অনেকে এই পথে আগায় না।’

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে প্রায় তিন শতাধিক ফুটবলার খেলেন। এত সংখ্যক ফুটবলারের মধ্যে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতনতা নেই অনেকেরই। আবার অধিকার আদায়ের জন্য দৌড়ঝাপেও অনীহা অনেকের, ‘বিদেশে প্রত্যেক ফুটবলারের এজেন্ট থাকে। সেই এজেন্টই সকল বিষয় দেখভাল করে। আমাদের ফুটবলাররা এখনো এজেন্টের মাধ্যমে চুক্তি করছে না। ফলে নিজেদেরকেই এই ঝক্কি বইতে হয় দাবি আদায় করতে হলে। এজন্যও অনেকে অনীহা থাকে।’

এক দশক ধরে লড়ছেন হাসান আল মামুন

জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাসান আল মামুন। যদিও এখন তার বড় পরিচয় জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচ। শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের কাছে তার কয়েক লক্ষ টাকা পাওনা। সেই পাওনা আদায়ের জন্য ফেডারেশনে আবেদন করেছিলেন। প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটি তার পক্ষে রায় দিলেও ক্লাব থেকে টাকা পাননি। এখনো তিনি হাল ছাড়েননি,‘আমি এটা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। গত মৌসুমের শুরুর দিকে শেখ রাসেল ক্লাব থেকে বলেছিল আমার টাকাটা দেবে। এখন তো আর ক্লাবটি ফুটবলেই নেই, আমি প্রয়োজনে ফিফায় যেতাম।’

দেশের ফুটবলার-কোচরা নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট নন। সেখানে হাসান আল মামুন প্রাপ্য টাকার জন্য এক দশক ধরে লড়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘এটা আমার ন্যায্য পাওনা। তাই এটার পেছনে বেশ কয়েক বছর ধরেই লেগেছিলাম। আমি টাকা আদায় করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলাম। আমার কাছে সকল ডকুমেন্টস রয়েছে। আমি যত্ন করে রেখেছি।’

ক্লাব কর্মকর্তারা কি বলছেন

ঘরোয়া ফুটবলে চুক্তিকৃত অর্থ পুরোপুরি পাওয়ার ঘটনা খুব কমই। আশি-নব্বইয়ের দশকে ফুটবল যখন রমরমা তখন পারিশ্রমিকের বিষয়টি মৌখিকই হতো। পেশাদার লিগের যুগে কাগজ-কলম বাধ্যতামূলক হলেও নেই প্রকৃত বাস্তবায়ন। সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও মোহামেডানের ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব বলেন, ‘আমরা যখন খেলেছি তখনও আমরা কখনো অর্ধেক আবার কখনো ২৫ শতাংশ অর্থ পাইনি। দুঃখজনক হলেও সত্য এখনো ফুটবলাররা বঞ্চিত হচ্ছে। এজন্য ক্লাবগুলোর অপেশাদারিত্বই দায়ী। দলবদলের সময় বড় অঙ্কের প্রস্তাব বা চুক্তি করে ফুটবলার নিলেও শেষ পর্যন্ত সেটা পূর্ণাঙ্গ করা হয় না। ক্লাবগুলো যতটুকু পারবে ততটুকু চুক্তি করলে এই সমস্যা হয় না।’

দেশের আরেক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়ন। সেই ক্লাবের দীর্ঘদিনের ম্যানেজার আমের খান বলেন,‘আসলে আমরা পেশাদার লিগ খেলছি ঠিকই কিন্তু কেউই পেশাদার নয়। না ফুটবলার, না ক্লাব। ফলে এই সমস্যাগুলো থেকেই যাচ্ছে। বিদেশি ফুটবলাররা পেশাদার বিধায় তারা ঠিকই অর্থ নিয়েই যাচ্ছেন।’ এক্ষেত্রে তিনি ফেডারেশনের স্টাফদের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে বলেন, ‘গত মৌসুমে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া ফেডারেশনে আবেদন করেছিল। সেটা ঝুলে ছিল কয়েক মাস। জাতীয় দলের অধিনায়ক যখন এমন পরিস্থিতিতে পড়েন তখন অন্য ফুটবলারদের পরিণতি অনেকটাই বোধগম্য।’

এজেড/এফআই