বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’ বিজয়ের ৫০ বছর পর এসেও ওই কথাটা কানে বাজছে। গুণী মানুষগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তাদের কদর করতে পারছে না বাংলাদেশ! 

অর্ধশত বছর পেরিয়ে এসেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিচ্ছেন অনেকেই। নতুন প্রজন্মের অনেকেই নিজ দেশের জার্সি রেখে যাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি সেই পাকিস্তানের জার্সি গায়ে আসছেন মাঠে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে নেই বিন্দু মাত্র আবেগ! মুক্তিযুদ্ধের সেই ইতিহাসটাও ঠিকঠাক জানতে পারছে না এই প্রজন্ম!

এই যেমন এখন-স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সেই বীরত্বের গল্প নেই যেন কোথাও। পত্রিকা কিংবা অন্তর্জালে কিছু চেনা লাইন লেখা হয় প্রতিবছর ডিসেম্বর কিংবা মার্চে। এরপরই সবশেষ। নতুন প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্ম নিয়েছেন তারা অনেকেই জানেন না সেই বীরত্ব গাঁথা। ফুটবল পায়েও যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই হয়েছে সেটা জানা নেই অনেকেরই। জানবেই বা কী করে পাঠ্য-পুস্তকে অনেক কিছু থাকলেও স্বাধীনতার সেই উত্তাল দিনগুলোর এই গল্পটা যে নেই। এমন কী এনিয়ে নেই কোন সিনেমাও!

এনিয়ে আক্ষেপের সঙ্গে কিছুটা অভিমানও আছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যদের। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে দলটির প্রধান সংগঠক ও প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেল ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন, ‘এটা অবশ্যই পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করা উচিত। যখন আমাদের শিশুরা দেখবে মহান মুক্তিযুদ্ধে খেলোয়াড়দের এই ভূমিকা ছিল-তাহলে দুটো দিক পড়াশোনার পাশাপাশি ওরা খেলাধুলায় মনোযোগী হবে। খেলায় কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তারা যদি খেলার প্রতি টান একেবারে শুরুতে পায়, তখন তারা দেখবে যে বিশ্বের ইতিহাসে ফুটবল পায়ে একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই-এমন ঘটনা আর একটিও নেই।’

পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সেই ফুটবল পায়ের যুদ্ধের গল্পটা অচিরেই অন্তর্ভুক্ত হোক এমনটাই চান প্যাটেল। সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমি চাই যেন মিথ্যাচার না হয়। সত্য ঘটনাই যেন শিশুদের জানানো হয়।’ যদিও এমন প্রত্যাশা যে সবার তাও কিন্তু নয়, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলেরই আরেক সদস্য প্রতাপ শঙ্কর হাজরা যেন কিছুটা অভিমান নিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন, ‘না, এটা পাঠ্য পুস্তকে অর্ন্তভুক্তির কোন দরকার নাই। সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার- দেশের উন্নয়ন। আর কিছুর দরকার নেই।’

তবে অতীত ভুলে কি এগিয়ে যাওয়া যায়? মোটেও না। সন্দেহ নেই অভিমান থেকেই এমন কথা বলেছেন ১৯৭১ সালের জুন মাসে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই অন্যতম সদস্য। কারণ এখন তো অন্তর্জালে কান রাখলেই কতশত বিতর্ক শোনা যায়। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। 

সাইদুর রহমান প্যাটেল বলছিলেন, ‘মাঝেমধ্যে হতাশাই লাগে, অনেককেই বলতে শুনি-পাকিস্তানই নাকি ভালো ছিল। কত ভয়ঙ্কর বিশ্বাস হৃদয়ে লালন করে বেড়ে উঠছে ওরা। আমরা হয়তো ওদের জানাতে পারিনি ঠিক মতো। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অনেক কিছুই অজানা বলে এমনটা ভাবছে ওরা। তবে দায়টা তো আমাদের। ধমক দিয়ে, আঙুল তুলে বুঝালে হবে না। কাছে ডেকে সত্য কথাটাই শোনাতে হবে। কেন স্বাধীনতা সংগ্রামটা যৌক্তিক ছিল আর স্বাধীন না হলে যে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকতে হতো সেই সত্যটাও ওদের বোঝাতে হবে।’

একদমই তাই, মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন কাঁদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করতে হলে অবশ্য নতুন প্রজন্মের সঙ্গে মিশতে হবে অগ্রজদের। ছোটদের বইয়ে তুলতে আনতে হবে সেইসব কথা। বীরত্বের গল্প। দৃপ্ত সাহসী মানুষগুলো যারা ফুটবলটাকে কী করে ‘অস্ত্র’ বানিয়েছিলেন এই গল্পটা যে না জানলেই নয়। ফুটবল দিয়ে পাকিস্তান সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্ভব-এমন পরিকল্পনা প্রথম এসেছিল সামসুল হকের মাথা থেকে। লক্ষ্য ছিল একটাই-এমন একটি ফুটবল দল গড়া হবে যারা ভারত জুড়ে ফুটবল খেলবে। এভাবে আমাদের স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি আদায়ের পথটা মসৃণ হয়ে উঠবে আরও। এভাবে ফুটবল খেলে যা আয় হবে তা পরে তুলে দেওয়া হবে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে।

’৭১ সালের জুন মাসে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। আকাশবাণীতে (কলকাতা রেডিও) বলে দেওয়া হলো বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত খেলোয়াড়দের মুজিবনগরে রিপোর্ট করার জন্য। ঘোষণার পর ৪০ জন ফুটবলার মুজিবনগর ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান থেকে ৩০ জন বাছাই করে গড়া হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। পরে আরও একজনকে অন্তর্ভুক্ত করলে সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১। 

একসময় এভাবেই আসে ২৪ জুলাই, সেই ঐতিহাসিক দিন। যেমনটা জানিয়েছেন খোন্দকার মো. নূরুন্নবী-‘ভোরবেলা কৃষ্ণনগরের ট্রেন ধরার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে এলাম। স্টেশনে এসে দেখি ২০-২৫ জন ঢাকার প্রথম বিভাগের খেলোয়াড়। তার মধ্যে ঢাকা মোহামেডানের ছয়-সাতজন। পিন্টু ভাই আমাদের দলের অধিনায়ক। তানভীর মাজহার তান্না আমাদের ম্যানেজার, ননীদা (ননী বসাক) আমাদের কোচ। সবাইকে কাছে পেয়ে খুবই ভালো লাগল। আমরা যথাসময়ে কৃষ্ণনগরে পৌঁছালাম। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে বিকেল ৪টার দিকে মাঠে উপস্থিত হলাম। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বনাম কৃষ্ণনগর একাদশের মধ্যে প্রদর্শনী ফুটবল খেলা। মাঠে প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছে। অনেক দিন পর মনে হচ্ছিল, ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শকপূর্ণ মাঠে এসেছি।’

দেশের বাইরে এভাবেই পাকিস্তানি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ফুটবল খেলে গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছেন তারা। গড়ে তুলেছেন ফান্ড। যা ব্যয় করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে। ম্যাচগুলো থেকে আয় করা ৫ লাখ টাকা মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে জমা দেন তারা। 

প্রশ্ন হলো- আমরা কি মনে রেখেছি তাদের? আমরা কি মনে রেখেছি ওই বীর ফুটবলারদের বীরত্বগাঁথা? মার্চ কিংবা ডিসেম্বর এলে হয়তো লেখা হয় তাদের বীরত্বের কথা। কিন্তু বাকিটা সময় আড়ালেই থাকেন তারা। তাদের ওই মহান প্রচেষ্টাকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য আরও বেশি কিছু কি করা যায় না? আমাদের শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে কি রাখা যেতে পারে না সেই গল্প? 

পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই সংগ্রামের অধ্যায়টা উঠে আসতে পারতো রুপালী পর্দাতেও। যেটা হয়তো আর বেশি ছুঁয়ে যেতো স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মকে। কিন্তু শুনতে খারাপ শোনালেও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে নিয়ে এখন অব্দি কোন সিনেমা কিংবা বড় বাজেটের কোন তথ্যচিত্রও নির্মিত হয়নি। অথচ পাশের দেশ ভারতে-এই চর্চাটা নিয়মিত চলছে। বায়োপিকে উঠে আসছে কিংবদন্তিদের গল্প। আর সেটা সাধারণের কাছে ছড়িয়েও পড়েছে।

ভারত পারে, অথচ আমাদের আশপাশে একটা স্বাধীন বাংলা দলের দুঃসাহসিক গল্প থাকলেও তা রুপালী পর্দায় তুলে আনতে পারি না। কেন পারি না- উত্তর খুঁজতে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হলো তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক আবু শাহেদ ইমনের। তিনি নির্মাতাদের কঠিন বাস্তবতার কথাটাই শোনালেন।

ইমন বলছিলেন, ‘একটা স্পোর্টস রিলেটেড ছবির জন্য যে রিসোর্সের দরকার হয়, সেটা তেমন নেই। একটা এধরেনর ছবি বানাতে গেলে, দর্শক গ্যালারি দরকার। একটা বড় মাঠের প্রয়োজন। এটা নিয়ে মাঠের পারমিশন পাওয়ার ব্যাপার থাকে। আমাদের যারা নায়ক নায়িকা আছেন তারাও খেলার সঙ্গে তেমন জড়িত থাকেন না। উনাদের তখন এই ব্যাপারগুলোতে যুক্ত করাটা সমস্যার হয়ে যায়। বাজার একটা বিষয়। আর টেকনিক্যাল সাপোর্টের ব্যাপারটাও ঝামেলা হয়। সব কিছু মিলিয়ে এটা করাটা ঝামেলার হয়ে যায়।’

স্বাধান বাংলা দল নিয়ে একটা ছবি নির্মাণ কী খুব বেশি কঠিন হয়ে যেতো? তেমন প্রযুক্তি কিংবা সিনেমার জন্য প্রযোজক পাওয়া কি খুব একটা কঠিন হয়ে যেতো? আবু শাহেদ ইমন এবারো ঠিক সরাসরি উত্তর দিতে পারলেন না, ‘না, তেমন একটা আমার জানা নেই। তবে আমরা একটা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে একটা কাজ করার চেষ্টা করেছি। ‘দামাল’র নামের সেই ছবিটি অবশ্য এখনো মুক্তি পায়নি। এই ছবি করতে বড় সমস্যা হয় কী স্পোর্টসের মানুষ ছাড়া তেমন করে ফুটিয়ে তোলা কঠিন। সহজ হচ্ছে প্রেমের গল্প বানানো।’

শেষ লাইনটাই হয়তো বাস্তবতা। শটকার্ট, সহজ পথেই হাঁটছে সবাই। আর এটা করতে গিয়ে গুণীর কদর হচ্ছে না। নতুন প্রজন্মও জানছে না কতো ত্যাগের বিনিময়ে মিলেছে একটা লাল-সবুজ পতাকা। নতুন প্রজন্মের যারা পথ হারিয়েছেন, তাদের পথে ফেরানোর সময়টাও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সাইদুর রহমান প্যাটেলদের দাবি পূরণের এইতো সময়!

এটি/এমএইচ