বাংলাদেশের হকির আলোচনায় বড় অংশ জুড়ে থাকে সাদেক-কামাল জুটি। আশি ও নব্বই দশকের দেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় আব্দুস সাদেক দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে। ২০১৭ সালের পর আবার মাস খানেকের জন্য দেশে এসেছেন। ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে তার ক্যারিয়ার, হকির সংকট-সম্ভাবনা, সাদেক-কামাল জুটি সহ অনেক বিষয়। 

প্রশ্ন: আপনার আমেরিকা-কানাডা প্রসঙ্গেই আসা যাক। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে ভালো ফর্মে থাকাবস্থায় প্রবাস জীবন বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন? 
সাদেক: সত্যিকার অর্থে তখনও আমি হকি দারুণ উপভোগ করছিলাম। কিন্তু সেই সময় জাতীয় দলে আমাকে ডাকা হয়নি। তখনই একটু বিষাদ অনুভব হয়। আমার যোগ্যতা-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও জাতীয় দলে ডাক পেলাম না। সেই সময় আমার পরিবারের আমেরিকার ভিসা হয়ে যায়। তাই আমেরিকায় চলে গেলাম। 

প্রশ্ন: আপনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন সেই সময়ে। এরপরও দলে ডাক না পাওয়ার কারণ কি ?
সাদেক: আমি অবশ্যই দলে ডাক পাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম। তখন আমি ছোট ক্লাবে ছিলাম। তাই হয়তো আমাকে ডাকা হয়নি। 

প্রশ্ন: তখন তো আপনি উষা ক্রীড়া চক্রে ছিলেন। ১৯৯৭ সালে উষা রানার্স আপ হয়েছিল। অনেকটা বড় দলই ছিল এরপরও আপনি ডাক পেলেন না!
সাদেক: মাঠের লড়াইয়ে উষা বড় দলের দিকে তখন মাত্র হাঁটা শুরু করছিল। কিন্তু ফেডারেশনে তখন সেভাবে প্রভাব ছিল না। এজন্যই হয়তো ডাক পাওয়া হয়নি। 

প্রশ্ন: আপনাদের সময় এবং পরবর্তীতেও তারকা খেলোয়ড়রা হয় আবাহনী নয় মোহামেডানে অথবা মেরিনার্স নয়তো উষায় দীর্ঘদিন খেলেছে। ফলে সেই ক্লাবের ঘরের ছেলে ছিল। আপনি কোনো ক্লাবে দীর্ঘস্থায়ী ছিলেন না কেন ?
সাদেক: আমার ক্যারিয়ার শুরু দ্বিতীয় বিভাগে বাংলাদেশ স্পোর্টিং দিয়ে। এরপর প্রথম বিভাগে ব্যাচেলর, অ্যাজাক্স, আবাহনী, মোহামেডান এবং উষা তিন ক্লাবেই খেলেছি। পারিশ্রমিক যেখানে বেশি পেয়েছি সেখানেই খেলেছি। ফলে এক ক্লাবে দীর্ঘস্থায়ী হওয়া হয়নি। তবে আমেরিকা না গেলে উষাতে হয়তো বাকি ক্যারিয়ার কাটিয়ে যেতাম।

প্রশ্ন: উষায় আপনার সঙ্গে রফিকুল ইসলাম কামালের দুর্দান্ত জুটি হয়েছিল। কামাল আপনার চেয়ে বয়সে এবং ক্যারিয়ারে উভয় জায়গায় বছর পাঁচেক ছোট। এরপরও তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দুর্দান্ত সব রেকর্ড কিভাবে গড়েছিলেন?
সাদেক: হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। বয়সে সে আমার চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের ছোট আবার জাতীয় দলের ক্যারিয়ারেও। আমি জাতীয় দলে খেলা শুরু করি ’৮৮ তে এবং সে ’৯৩। সে আমার জুনিয়র হলেও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খেলার মাঠে আমরা আমাদের মতোই সব কিছু করতে পেরেছি।  

প্রশ্ন: কিভাবে আপনাদের মধ্যে এত সুন্দর কম্বিনেশন হয়েছে সেটাই জানতে চাই। কী কারণে সাদেক-কামাল জুটি এত আলোচনায়?
সাদেক: আমি গোল করার চেয়ে করানোতে বেশি আনন্দ পেতাম। অন্যদিকে কামালের গোল করার দারুণ দক্ষতা ছিল। পাশাপাশি তার পজিশন সেন্স এবং ডজিং সক্ষমতাও ছিল। সে আমাকে বুঝতে পারত কখন আমি বল ছাড়ব বা আরও ধরব। ফলে দুই জনের মধ্যে অসম্ভব বোঝাপড়া ছিল। আমরা এক সঙ্গে উষা ক্লাব, ঢাকা জেলা এবং জাতীয় দল তিনটি মাধ্যমে খেলেছি এবং তিন ক্ষেত্রেই আমাদের জুটি সফল ছিল।  

প্রশ্ন: ফুটবল লিগে ১৯৮২ সালে সালাম মুর্শেদীর ২৭ গোলের অধিকাংশই বাদল রায়ের তৈরি করা। কামালের লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতার ক্ষেত্রেও আপনাকে বাদল রায়ের সমান অবদানই দেয়া হয়।
সাদেক: আসলে কামাল অনেক ভালো খেলোয়াড় ছিল বলেই এত গোল সে করতে পেরেছে। আমি চেষ্টা করেছি তাকে সর্বোচ্চ সহায়তা করতে। সহায়তাগুলো গোলে রুপান্তর হলে আনন্দ পেতাম।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে আপনাদের জুটি সবচেয়ে জনপ্রিয় তো বটেই, সেরা বলা যায় কি?
সাদেক: আমেরিকা এবং কানাডায় অনেক দিন ধরে আছি। সেখানেও বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাদেক-কামাল জুটি নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। দেশে অনেক দিন পর পর আসি। তখনও অনেকে এই জুটির কথা বলে। আমরা মানুষের মনে স্থান নিতে পেরেছি এটা সত্য। আমাদের আগে বা পরে এমন জুটির কথা সেভাবে শোনা যায় না। আমরা বেশ কয়েক বছর একই ধারাবাহিকতায় খেলেছি। ফলে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে হকির সেরা জুটি বলাই যায়। 

প্রশ্ন: হকির অনেকের মতে, খেলোয়াড়ি গুণাবলিতে আপনি কামালের চেয়েও নাকি এগিয়ে কিন্তু হকিতে আপনার নামটি কামালের সঙ্গেই বেশি আসে। অন্য দিকে হকিতে সাদেক নাম আসলে অনেকেই সিনিয়র আব্দুস সাদেককে আগে স্মরণ করে। এই বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন? 
সাদেক: সিনিয়র সাদেক ভাই হকির কিংবদন্তী। তিনি অসাধারণ খেলোয়াড়। পাকিস্তান দলেও ছিলেন। আমার সময়ে আমি সেরাদের একজন ছিলাম। আমারও পরিচিতি রয়েছে, মানুষ মোটামুটি ভালোই চেনে। ফর্ম থাকাবস্থায় বিদেশে না গিয়ে আরো কিছু দিন খেললে হয়তো পরিচিতি আরও বাড়ত। 

প্রশ্ন: বিদেশে যাওয়ার জন্য হকির ক্যারিয়ার একটু আগেই শেষ করলেন। এজন্য আফসোস হতো না?
সাদেক: আমেরিকা গিয়ে কিছু দিন হকি খেলেছি। চার বছর আমেরিকা থাকার পর কানাডা যাই। টরেন্টো লিগে দুই বার লিগ সেরা হয়েছিলাম। এরপর কানাডায় স্থায়ী হওয়ার দিকে বেশি মনোযোগী হই। এখন বেশ ভালোই আছি। আমার সন্তানরাও কানাডায় সুন্দর জীবনযাপন করছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার এনায়েতুর রহমান খান, হকির সেরাদের একজন আপনি প্রবাসী। সেরা খেলোয়াড়দের এরকম দেশ বিমুখতা ক্রীড়াঙ্গনের জন্য নেতিবাচক কিনা?
সাদেক: অনেক সুন্দর মিলিয়েছেন তো (হাসি)। ফুটবলের আরেক কিংবদন্তী মহসীন ভাইও ছিলেন কানাডায়। খেলোয়াড় হিসেবে আমরা দেশকে সর্বোচ্চটাই দেয়ার চেষ্টা করেছি। এরপর ব্যক্তি জীবন, পরিবারের একটা বিষয় থাকে। হয়তো আমার এবং তাদের ভাবনাটা পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একবিন্দুতে গিয়ে মিলেছে। ভালো খেলোয়াড় হলেই যে ভালো কোচ, সংগঠক হতে পারতাম বিষয়টি সেই রকমও না কিন্তু। 

প্রশ্ন: এক দশক জাতীয় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় ছিলেন। জেলা ও ক্লাব দলের হয়েও শিরোপা জিতেছেন। বাংলাদেশের হকির সেরাদের একজন আপনি। এরপরও ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ পদক জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাননি। খানিকটা আফসোস লাগে না?
সাদেক: আমি হকির জন্য কি করেছি, এটা সবাই দেখেছে ও জানে। এরপরও যদি আবেদন করে পুরস্কার নিতে হয় সেটা খুব একটা সমীচিন নয়। আমার চেয়ে কম গুণসম্পন্ন অনেকে পুরস্কার পেয়েছে নানা ক্ষেত্রে। বিষয়টি একটু কষ্টই লাগে। এবার দেশে আসার পর অনেকে বলেছে আবেদন করতে। দেখি এবার হয়তো আবেদন করতে পারি।  

প্রশ্ন: সুদূর কানাডা থেকে দেশের হকির খোজ খবর রাখেন কিনা?
সাদেক: হ্যাঁ নিয়মিতই রাখি। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ দেখেছি অনেক গুলো ম্যাচই। টি-স্পোর্টস সরাসরি দেখানোয় খেলা খুব একটা মিস হয়নি। বাংলাদেশে খেলোয়াড়দের মান কিন্তু ভালোই।   

প্রশ্ন: আপনাদের সময়ের চেয়েও কি ভালো?
সাদেক: আসলে প্রজন্মের সঙ্গে প্রজন্মের তুলনা হয় না। কামাল তার সময়ের সেরা, জিমি তার সময়ের। আমাদের সময় ব্যক্তিগত স্কিলের খেলা ছিল। এখন টিম গেম এবং ফিটনেস নির্ভর। ফলে দুই সময়ের মধ্যে সেভাবে পার্থক্য করা যায় না। 

প্রশ্ন: বাংলাদেশের হকির সম্ভাবনা দেখেন?
সাদেক: অবশ্যই দেখি। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এই ছেলেরাও হকিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। 

এজেড/এনইআর