চলাফেরা ও কথাবার্তায় একেবারেই নীরবতা। টেবিল টেনিসের বোর্ডে রামহিম লিয়ান বমের চিত্র পুরো উল্টো। তার আগ্রাসী খেলায় কুপোকাত হন প্রতিপক্ষরা। একে একে সবাইকে পরাস্ত করে সদ্য সমাপ্ত ৩৯তম টেবিল টেনিসে (টিটি) তিনি নতুন ইতিহাস লিখেছেন। প্রথম আদিবাসী হিসেবে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বান্দরবন থেকে ওঠে আসা তরুণ রামহিম। 

দেশে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক খেলায় আদিবাসীদের দাপট থাকলেও সেখানে বমদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্য আদিবাসীদের তুলনায় নিজেদের সংখ্যাও অনেক কম বললেন রামহিম, ‘আগের এক শুমারিতে আমাদের গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৬ হাজার। সেটা এখন বেড়ে হয়তোবা আরও কয়েক হাজার বেশি হতে পারে।’

এত স্বল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকেই হয়েছেন দেশ সেরা টিটি খেলোয়াড়। যা রামহিম নিজের সম্প্রদায়ের বড় প্রাপ্তি হিসেবে মনে করেন, ‘পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কেউ খেলাধুলায় নেই। আমার দাদি প্রায়ই বলে ভালোমতো পড়তে। আমার মন তো খেলায়। আমার এই অর্জন নিজের জন্য যেমন প্রাপ্তি তেমনি বান্দরবন বগা লেকেরও প্রাপ্তি।’

বান্দরবানের বগা লেকে কাঠের বাড়ি রামহিমদের। রামহিমের বাবা খ্রিস্টান ধর্মীয় কাজ করেন আর মা গৃহিণী। টানাটানির সংসারে টিটির মাধ্যমে সহায়তা করছেন এইচএসসি পরীক্ষার্থী রামহিম। এখনও কোনো সার্ভিসেস দলের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে যোগ না দিলেও গত বছর লিগ খেলে কয়েক লাখ টাকা পেয়েছেন। এবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেছেন চট্টগ্রামের হয়ে। খেলাধুলায় মন থাকলেও পড়াশোনাতেও একেবারে মন্দ নন রামহিম। কোয়ান্টাম থেকে এসএসসিতে মানবিক বিভাগে অংশ নিয়ে ৪.৩৯ পেয়েছেন। এবার ঢাকার টিএন্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসিতে অংশ নেবেন। টেবিল টেনিস ফেডারেশনে করছেন নিবিড় পড়াশোনা।

সার্টিফিকেটে রামহিমের জন্ম ২০০৫ সালে। তাই এবার অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও জুনিয়রে খেলেছেন। জুনিয়র এবং সিনিয়র উভয় ইভেন্টে দেশসেরা হয়েছেন রামহিম। এই বয়সেই দেশ সেরা টিটি খেলোয়াড় হওয়ার রহস্য সম্পর্কে বলেন, ‘আমি অসম্ভব পরিশ্রম করেছি। এমনও দিন গিয়েছে অনুশীলন করেছি দশ ঘণ্টারও বেশি সময়। সাফল্য অর্জনে অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই।’

নিজের পরিশ্রমের পাশাপাশি ফেডারেশনকেও বিশেষ ধন্যবাদ দিলেন এই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, ‘আমার আজকের এই অবস্থানের জন্য মূল অবদান সুমন স্যারের (টেবিল টেনিস ফেডারেশনের সহ-সভাপতি) তিনি আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। আমার এই জাতীয় শিরোপা সুমন স্যার এবং ফেডারেশনকে উৎসর্গ করেছি।’ 

প্রায় আড়াই বছর টেবিল টেনিস ফেডারেশন খেলোয়াড়দের নিয়ে ক্যাম্প করাচ্ছে। রামহিম ফেডারেশনের নিবিড় অনুশীলনের মধ্যেই রয়েছেন। সাবেক খেলোয়াড় ও টিটি কোচ মোহাম্মদ আলী খুব কাছ থেকে অনুশীলন করিয়েছেন রামহিমকে। রামহিম সম্পর্কে আলীর পর্যবেক্ষণ, ‘তাকে আমি অনেকদিন থেকেই দেখছি। বান্দরবানে কোয়ান্টামে ছিল। তাকে জাতীয় পর্যায়ে এনেছে সুমনই (ফেডারেশনের সহ-সভাপতি)। রামহিমের অ্যাটাকিং গুণ অসাধারণ। বিশেষ করে তার বড় শক্তির জায়গা ব্যাকহ্যান্ড এবং দুই হাতেই সে দারুণ দক্ষ।’

ফেডারেশনের বর্তমান সদস্য এবং একাধিকবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সাইদুল হক সাদী অবশ্য রামহিমকে বিশেষ পরামর্শ দিয়েছেন, ‘সে অসাধারণ খেলোয়াড়। সব গুণই তার মধ্যে রয়েছে। এখন দরকার তার গেম প্ল্যানিং। এই গেম প্ল্যানিং যত উন্নত করতে পারবে ততই সে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করতে পারবে।’ 

বাংলাদেশের টেবিল টেনিসে কচি-রচি, মাহবুব-মানসরা অনেকদিন রাজত্ব করেছেন। মাহবুব-মানসরা এখনও খেললেও তরুণরা গত তিন আসরে সেরা হয়েছেন। গত দুই আসরে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন হৃদয়। এবার রামহিম তার জায়গা নিলেও হৃদয়ের কণ্ঠে সন্তুষ্টি, ‘সে আমার রুমমেট এবং ডাবলস টিমের সঙ্গী। একবার আমি জিতব আরেকবার সে জিতবে এটাই তো খেলা।’

মাহবুব-মানসের পর বাংলাদেশের টেবিল টেনিসের ভার এখন হৃদয়-রামহিমের হাতে। এটি উপভোগের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জিং বলেও দাবি রামহিমের, ‘আমি দেশ সেরা এটি যেমন আনন্দের আবার তেমনি দেশের প্রতি আমার দায়িত্বও অনেক সেটি অনেক চ্যালেঞ্জের।’ এককে রামহিমের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও দ্বৈতের সঙ্গী হৃদয়ও এতে সহমত জানান।

এজেড/এএইচএস