বাংলাদেশের সব ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশনের অভিভাবক জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সকল ক্রীড়া স্থাপনার মালিকানাও সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের। ক্রীড়াঙ্গনের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নানা অসঙ্গতি, দুর্বলতা ও সংকটের বিষয়গুলো নিয়ে ধারবাহিক প্রতিবেদন করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।

তৃতীয় পর্বে তুলে ধরা হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ক্রীড়া নির্ভরতা থেকে কীভাবে নির্মাণ-সংস্কারমুখী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

কোচের চেয়ে প্রকৌশলী বেশি

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচের কক্ষে একসময় তারার মেলা ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও ভলিবলের তারকা খেলোয়াড়রা অবসরের পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ ছিলেন। জালাল আহমেদ চৌধুরী, মোস্তফা কামালের মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা ছিলেন এনএসসি’র কোচ। কাবাডির অন্যতম কিংবদন্তী আব্দুল জলিল ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে নবীন কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তখন কোচের সংখ্যা ছিল চল্লিশের বেশি। সময়ের পরিক্রমায় এখন কোচের সংখ্যা কমতে কমতে দশ জনে নেমে এসেছে। 

আশির দশকের মাঝামাঝি ক্রীড়া পরিষদে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ চালু হয়। সেই বিভাগের পরিচালকের অধীনে থাকেন প্রকৌশলীরা। যারা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বিভিন্ন নির্মাণ ও সংস্কার কাজ দেখভাল করেন। বর্তমানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে প্রকৌশলীর সংখ্যা প্রায় বিশজন।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক পরিচালক ক্রীড়া ও বিশিষ্ট সংগঠক ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘সাদেক হোসেন খোকার পর সরাসরি ক্রীড়াঙ্গনের সাথে সম্পৃক্ত ক্রীড়া মন্ত্রী আসেনি। এরপর ক্রীড়াঙ্গনে যারা মন্ত্রী হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে অর্থব্যয় হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় নির্মাণের পর সংস্কারেও দ্বিগুণ ব্যয় লেগেছে। সব মন্ত্রীই বিগত তিন দশকে চেষ্টা করেছেন নিজ জেলায় স্টেডিয়াম-সুইমিংপুল করতে। সেখানে সেই খেলার ইতিহাস ও বাস্তবতা বিচার করার প্রয়োজন মনে করেনি। মন্ত্রীদের আগ্রহে প্রকৌশল বিভাগে নানা প্রকল্প এনেছে। এতে পরিকল্পনা ও উন্নয়নের কর্মকান্ড ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে হতে ক্রীড়া খাতে অবহেলিত হয়ে পড়েছে।’

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ মূলত খেলাধুলার প্রতিষ্ঠান। খেলাধুলার উন্নয়নের সঙ্গে অবশ্যই স্টেডিয়াম ও নির্মাণের সম্পর্ক রয়েছে। তবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের গত দুই যুগের বেশি সময়ের কর্মকাণ্ড অনেকটাই নির্মাণ-কেন্দ্রিক। ফলে ক্রীড়া শাখার চেয়ে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের কলেবর ও গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণ। 

চলে যান কোচরা, বিজ্ঞপ্তিতেও মেলে না

খেলার উন্নয়নে কোচের কোনো বিকল্প নেই। ফুটবল, ক্রিকেট, শুটিং ও আরচ্যারি ছাড়া অন্য সকল ফেডারেশনের কোচ রাখার সামর্থ্য সেই অর্থে নেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ খেলার উন্নয়ন ও ধারাবাহিক কাজের জন্য প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কোচ রাখছে। 

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে নিয়োগ পেয়ে অনেক কোচ অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। বাংলাদেশের সাবেক দ্রুততম মানব আব্দুল্লাহ হেল কাফি একসময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ছেড়ে বিকেএসপিতে যোগ দেন। বিসিবির ম্যাচ আম্পায়ার শওকতুর রহমান চিনুও একসময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগে চাকরি নেন। 

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচের কক্ষে এক সময় তারার মেলা ছিল। ওপরের ছবিটি ২০০১ সালের দিকের।

প্রায় পনেরো বছরের বেশি সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচের শূন্য পদ পূরণ হচ্ছে না। কয়েক দফা বিজ্ঞপ্তি দিয়েও কোচ মেলেনি। এর কারণ হিসেবে এনএসসির বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত কোচদের বক্তব্য প্রায় একইরকম, ‘ক্রীড়া পরিষদে কোচদের শুরুতে দ্বিতীয় গ্রেড ধরা হয়। বিকেএসপির কোচ, ক্রীড়া অফিসার এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগে প্রথম শ্রেণি হিসেবে স্বীকৃতি পান শুরুতে। এ জন্য অনেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচ হতে আগ্রহী নন। আবার হলেও আগ্রহের তালিকায় এনএসসি থাকে পরে। ফলে অনেকে যোগ দিয়েও অন্যত্র চলে যান সুযোগ পেলে।’

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচ নিয়োগে সর্বোচ্চ বয়স থাকে ৩২। ঐ বয়সে অনেকে খেলাধুলা করে। পাশাপাশি আরেকটি চাহিদা হলো ডিপ্লোমা। এই প্রসঙ্গে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অবসরপ্রাপ্ত কোচ মোশাররফ বাদল বলেন, ‘এখন সবাই ফুটবলে এএফসির কোচিং সার্টিফিকেট নেয়। যা এশিয়ার যে কোনো জায়গায় ফুটবল কোচিংয়ের জন্য প্রযোজ্য। এখন কেউ ডিপ্লোমা করে না। কোচের শূন্যপদ পূরণে এটাও একটা প্রতিবন্ধকতা।’

ক্রীড়া পরিষদে কোচদের শুরুতে দ্বিতীয় গ্রেড ধরা হয়। বিকেএসপির কোচ, ক্রীড়া অফিসার এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগে প্রথম শ্রেণি হিসেবে স্বীকৃতি পান শুরুতে। এ জন্য অনেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচ হতে আগ্রহী নয়, আবার হলেও আগ্রহের তালিকায় এনএসসি থাকে পরে। ফলে অনেকে যোগ দিয়েও অন্যত্র চলে যায় সুযোগ পেলে।

ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- বিকেএসপি। এখানে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত কোচ পদে নিয়োগ হয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচদের অনেক দিনের দাবি বয়স সীমা বৃদ্ধি করা। এটা করলেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে।

কোচরা কখনো প্রশাসক কখনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা

এমনিতেই কোচের স্বল্পতা, তার ওপর কোচেরা কখনো প্রশাসক আবার কখনো প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক অ্যাথলেটিক্স কোচ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া তার চাকরি জীবনে কোচিং সেভাবে করানোর সুযোগই পাননি। সিংহভাগ সময় প্রশাসক হিসেবেই কাজ করেছেন তিনি। কমলাপুর ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম মিলিয়ে তার প্রশাসক জীবন কেটেছে প্রায় দুই দশক।

সাবেক হকি খেলোয়াড় মোবারক করিম লিটন মূলত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের হকি কোচ। তিনিও প্রশাসকের ভূমিকায় অনেক দিন। ভারত্তোলন কোচ ফারুক সরকার বিভাগীয় পর্যায়ে উপ পরিচালকের দায়িত্বেও ছিলেন। ভারত্তোলনের আরেক কোচ শাহরিয়া সুলতানা সূচি কোচিংয়ের পাশাপাশি মিরপুর সুইমিং কমপ্লেক্সের প্রশাসকের দায়িত্বে রয়েছেন। এর আগে ছিলেন ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বর্তমান প্রশাসক কামরুল ইসলাম কিরণও মূলত হ্যান্ডবল কোচ। 

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচদের প্রতিভা অন্বেষণের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বছরের ৩-৪ মাস। বাকি সময় তেমন কোনো কাজ থাকে না। কোনো ফেডারেশন জাতীয় দলের ক্যাম্প বা বিশেষ প্রয়োজনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচদের শরণাপন্ন হয়। আবার কখনো ক্লাব বা সার্ভিসেস সংস্থাও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচদের সার্ভিস নিয়ে থাকে। এতে কোচরাও খানিকটা বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পান। এ ছাড়া প্রায় সময় কোচদের অলস সময় কাটাতে হয়। কোচরা নিজেদের উন্নয়নের চেষ্টা করেন না, আবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও তাদের নিয়ে তেমন ভাবে না। কোচদের বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা সেভাবে নেই বললেই চলে।

তালিকাভুক্ত ঠিকাদার ১৫৯, টেন্ডার প্রক্রিয়া 'প্রশ্নবিদ্ধ'

২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৫৯। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ৫০০ টাকা মূল্যের ফরমের সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্স ও আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র জমা দিয়ে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে হয়। বেশ কয়েকটি আবেদন জমা পড়লে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একটি সভার মাধ্যমে আবেদন গৃহীত বা বাতিল করে। 

২০১৬-১৭ অর্থ বছর থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধিকাংশ টেন্ডার এখন ইজিপি প্রক্রিয়ায় হওয়ায় এনএসসি তালিকাভুক্তি এখন আর প্রয়োজন পড়ে না। ইজিপি পদ্ধতিতে যে কেউ নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করে টেন্ডার প্রক্রিয়া অংশগ্রহণ করতে পারে। পুরোটা অনলাইন ভিত্তিক হওয়ায় টেন্ডার সংক্রান্ত কাজে এনএসসিতে আসারও প্রয়োজন পড়ে না। এলটিএম পদ্ধতিতে টেন্ডার করলে অবশ্য তালিকাভুক্ত ঠিকাদাররাই এতে অংশগ্রহণ করতে পারেন শুধু। 

ঠিকাদারদের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তালিকাভুক্ত হওয়া প্রয়োজন ছিল ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত। কারণ তখন টেন্ডার সরাসরি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে এসে কিনতে এবং জমা দিতে হতো। সেই সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার হওয়ার একটা শর্তও থাকত অনেক বিজ্ঞপ্তিতে। সরাসরি টেন্ডার জমা দান ও কেনার সেই সময় চলত পেশীশক্তির খেলা। এতে অনেকে টেন্ডার জমা দিতে পারেনি। অন্য পক্ষ যেন টেন্ডার জমা দিতে না পারে এজন্য মহড়া হয়েছেও অনেক। আবার টেন্ডার ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। হাতে জমা যুগে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের কর্মকর্তারা টেন্ডার সমাপ্ত হওয়ার দুই তিন দিন আগে অফিসের বাইরে থাকতেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ মোতায়েনও হয়েছে। টেন্ডার জমা দান প্রক্রিয়া যদি এ রকম হয় ফলে সেখানে টেন্ডার বণ্টন/প্রদানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কতটুকু চাপে বা প্রভাবিত ছিল সেটি সহজেই অনুমেয়। 

দামি পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে ঠিকাদার সঠিক ও প্রকৃত জিনিস আমদানি করছে কি না এটা নিশ্চিত হতেই মূলত এনএসসি কর্তারা বিদেশ সফর করে থাকেন। তবে এসব সফর মূলত আনন্দ ভ্রমণই। ঠিকাদারের পয়সায় এই ভ্রমণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এতে ঐ ঠিকাদারের কাজে ত্রুটি ধরা পড়লে এনএসসি জবাবদিহি করতে পারবে কি না সেই প্রশ্ন ওঠে। 

প্রায় আট বছর ধরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ইজিপির মাধ্যমে টেন্ডার করছে। অনলাইন ভিত্তিক এই প্রক্রিয়ার ত্রুটি ও দুর্বলতা বাহ্যিকভাবে তেমন দৃশ্যমান নয়। তবে টেন্ডার বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্প পরিচালক/টেন্ডারের সততা এবং নিরপেক্ষতার ওপর কিছু বিষয় নির্ভর করে এই জাতীয় পদ্ধতিতে। কোনো আবেদনকারীকে তথ্য ফাঁস বা প্রদানের মাধ্যমে টেন্ডার প্রাপ্তিতে সহায়তা করার সুযোগ এই পদ্ধতির একটি দুর্বল দিক হিসেবে বিবেচিত।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক পরিচালক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নুরুল হক প্রধান বলেন, 'এটা আসলে অস্বীকার করার উপায় নেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান হলেও গত ৩০ বছরে নির্মাণভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। খেলোয়াড়-কোচদের তুলনায় ঠিকাদারদেরই যেন প্রাধান্য। অনেক সময় ঠিকাদারদের চাপে তৈরি হয় প্রকল্প, আবার মন্ত্রী সচিবের অনুরোধে সৃষ্টি করতে হয় নতুন ক্রীড়া স্থাপনা। ফলে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তাদের অনেক সময় কিছুই করার থাকে না।'

টেন্ডারের সঙ্গে থাকে সৌজন্য সফর, নেই ‘কালো’ তালিকা

অনেক নির্মাণ-সংস্কার কাজে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করেন। সেই সকল ব্যয় অধিকাংশ সময় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই ব্যয় করে। দামি পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে ঠিকাদার সঠিক ও প্রকৃত জিনিস আমদানি করছে কি না এটা নিশ্চিত হতেই মূলত এনএসসি কর্তারা বিদেশ সফর করেন। তবে ঐ সকল সফর মূলত আনন্দ ভ্রমণই। ঠিকাদারের পয়সায় এই ভ্রমণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এতে ঐ ঠিকাদারের কাজে ভুল বা ত্রুটি ধরা পড়লে এনএসসি প্রকৃত জবাবদিহিতা করতে পারবে কি না সেই প্রশ্ন ওঠে। আবার ঐ ঠিকাদার যেন পরবর্তীতে কাজও পায় সেটারও একটা পরোক্ষ দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে প্রচলিত ধারণা রয়েছে।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনেক নির্মাণ-সংস্কার কাজ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে গত এক দশকের মধ্যে মিরপুর সাঁতার কমপ্লেক্সে স্কোরবোর্ড সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এ নিয়ে অনেক সমালোচনার প্রেক্ষিতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব বলেছিলেন প্রয়োজনে ঠিকাদারকে ব্ল্যাকলিস্ট করা হবে। পরবর্তীতে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো সেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে স্কোরবোর্ডের কাজ পায়। এ নিয়ে সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপনও বিস্মিত হয়েছিলেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে এখন পর্যন্ত কোনো ঠিকাদার কালো তালিকাভুক্ত হয়েছেন এমন কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। 

ক্রীড়া সংগঠকরাও আছেন ঠিকাদারিতে

ক্রীড়া সংগঠকরা স্বেচ্ছায় ক্রীড়াঙ্গনে সময়-শ্রম দেন। আর্থিকভাবে তারা লাভবান হন না এমন ধারণাই প্রচলিত ক্রীড়াঙ্গনে। তবে ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যে আবার কেউ কেউ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে নির্মাণ-সংস্কার কাজে ঠিকাদারি ব্যবসাও করেন। এর মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনের সেক্রেটারিসহ বিশিষ্ট সংগঠকরাও আছেন।

ক্রীড়া সংগঠকদের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ব্যবসা নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে বেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেকের মতে, ক্রীড়া সংগঠকদের ক্রীড়াঙ্গন সম্পর্কিত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না থাকাই শ্রেয়। এতে সম্পর্ক-পরিচয়ের কারণে কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন-জবাবদিহিতা করতে পারে না জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। পাশাপাশি সংগঠকরা ক্রীড়াঙ্গনকে স্বেচ্ছায় সেবা দিচ্ছেন সেই ধারণা থাকছে না, পরোক্ষভাবে ব্যবসা/আয়ও করছেন। আবার আরেক পক্ষের দৃষ্টিতে, ক্রীড়া সংগঠক হলেও তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যদি সুনির্দিষ্ট আইন ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজ পায় তাহলে প্রশ্ন তোলা যুক্তিযুক্ত নয়। 

এনএসসির ক্রীড়া স্থাপনা ৩২১

বাংলাদেশের সকল স্টেডিয়ামের মালিকানা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্থাপনার সংখ্যা ৩২১। এর মধ্যে প্রথম ধাপে সম্পন্ন হওয়া শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম রয়েছে ১২৫টি এবং দ্বিতীয় ধাপে উদ্বোধন হওয়া মিনি স্টেডিয়াম ২৫টি। এই মিনি স্টেডিয়াম ছাড়া অন্যান্য স্টেডিয়াম, জিমনিশিয়াম, শেড, শুটিং রেঞ্জ মিলিয়ে ক্রীড়া পরিষদের স্থাপনার সংখ্যা ১৮১। 

জেলা স্টেডিয়ামের সংখ্যা ৬৩। রাজধানী ঢাকা ছাড়া বাকি সব জেলাতেই জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে একটি করে জেলা স্টেডিয়াম রয়েছে। জেলা স্টেডিয়ামগুলো মূলত ফুটবল উপযোগী হলেও এখানে জেলা ক্রীড়া সংস্থা ক্রিকেট এবং অন্যান্য খেলাধূলাও আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু ও কমলাপুর স্টেডিয়াম ছাড়া ফুটবলের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দকৃত অন্য কোনো স্টেডিয়াম নেই।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সংখ্যা ৮টি। যদিও সবগুলো এখন আন্তর্জাতিক মানের অবস্থায় নেই ব্যবহার না করার ফলে। কাবাডি, ভলিবল, হকি,বক্সিং স্টেডিয়াম রাজধানী ঢাকাতেই। জেলা পর্যায়ে এই সকল খেলার জন্য নেই আলাদা কোনো স্থাপনা। ইনডোর স্টেডিয়াম রয়েছে ৭টি, সুইমিংপুলের সংখ্যা ২৩টি ,শুটিং রেঞ্জ ও টেনিস কোর্ট ৬টি।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব) মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশের ক্রীড়া অবকাঠামো পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলে যা ছিল সেটাই মৌলিকভাবে রয়েছে। এই যেমন জাতীয় স্টেডিয়াম। এটা পাকিস্তান আমলের। বাংলাদেশের এই স্টেডিয়ামের পেছনে শতশত কোটি টাকা খরচ করেও এখনো পূর্ণতা থাকে না। ক্রীড়া অবকাঠামো নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা নীতিমালা নেই। ফেডারেশনগুলো চলে যেভাবে অ্যাডহক মাধ্যমে, ক্রীড়া স্থাপনাও সেভাবেই।'

নেই রক্ষণাবেক্ষণ, প্রয়োজন হয় বারবার সংস্কার

কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্টেডিয়াম বা ক্রীড়া স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের পর যত্ন এবং টেকসইয়ের জন্য প্রয়োজন সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য থাকে না কোনো বাজেট এবং লোকবল। ফলে একটি স্থাপনা কয়েক বছরের মধ্যে আবার সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে। তখন আবার উন্নয়ন এবং সংস্কারের নামে নতুন প্রকল্প তৈরি হয়। সেই প্রকল্প অনুমোদন হলে পুনরায় আবার লাখ লাখ বা কোটি টাকা ব্যয়ের রাস্তা প্রশস্ত হয়।

কোটি টাকার স্কোরবোর্ড অচল। ফাইল ছবি 

সাঁতারের উন্নয়নে জেলা পর্যায়ে বিশের অধিক সুইমিংপুল করা হয়েছে। সেই সকল সুইমিংপুল নলকূপ, নোনা পানি নানা প্রতিবন্ধকতায় সচল নেই। একেবারে সচল নেই বা জাতীয় পর্যায়ে সাঁতারের জন্য উপযুক্ত নেই এমন সংখ্যাও অনেক। এত অর্থ ব্যয়ের পর তাই উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

এসএ গেমসের স্বর্ণজয়ী সাতাঁরু মাহফুজা আক্তার শিলা বলেন, 'এটি ক্রীড়াঙ্গনের খুব দুঃখ, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ক্রীড়া স্থাপনাগুলো সঠিকভাবে পরিচর্যা করে না। এতে আমরা ক্রীড়াবিদরা নানা ভোগান্তিতে পড়ি। যার প্রভাব পড়ে আন্তর্জাতিক খেলাতেও। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এটা বুঝেও ক্রীড়া অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষনে কোনো পদক্ষেপ নেয় না।'

এজেড/এফআই/জেএস