সাঁতারু সামিউল ইসলাম রাফি
‘সরাসরি অলিম্পিক খেলতে চাই’
সদ্য সমাপ্ত ৩৪তম জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ২০টি রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে সামিউল ইসলাম রাফি ছয়টি ব্যক্তিগত ও একটি দলীয় রেকর্ডের অংশীদার। তিনি ১২ ইভেন্টে অংশ নিয়ে এগারোটিতেই জিতেছেন স্বর্ণ, আরেকটিতে রৌপ্য। গত দুই আসরের মতো এবারও তিনিই হয়েছেন সেরা পুরুষ সাঁতারু। দেশের সেরা সাঁতারু রাফি নিজের লক্ষ্য, সাঁতারের বাস্তবতাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরের সাথে।
ঢাকা পোস্ট : ৩৪তম জাতীয় সাঁতারে আপনার রেকর্ড ও স্বর্ণপদকের ছড়াছড়ি। এত সাফল্যের রহস্য কী?
বিজ্ঞাপন
রাফি : প্রথম কারণ পরিশ্রম। দ্বিতীয় কারণ ভালো কোচিং। থাইল্যান্ডে উন্নত প্রশিক্ষণে ছিলাম। ১ সেপ্টেম্বর দেশে আসার পর জাতীয় দলের মিশরীয় কোচের ট্রেনিং পেয়েছি। সবকিছু মিলিয়ে এই সাফল্য।
ঢাকা পোস্ট : আপনি থাইল্যান্ডে উন্নত প্রশিক্ষণে ছিলেন। এরপরও ঢাকায় মিশরীয় কোচ সাঈদ ম্যাকডির অধীনে দুই মাস অনুশীলনে কোন দিকগুলোতে আপনার উন্নতি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
রাফি : উনি অত্যন্ত ভালো মানের কোচ। আমি থাইল্যান্ডে যা শিখেছি উনার কোচিংয়ে সেটা আরো ধারাবাহিক হওয়ায় অনেক উন্নতি হয়েছে। যেমন আমার মাসল পাওয়ার বেড়েছে অনেক। এটি সাঁতারের গতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। শুধু আমারই নয়, কাজল, রোমানা আপু অনেকেই ভালো করেছে তার কোচিংয়ে। এবার এত রেকর্ডের পেছনে কয়েক মাসের অনুশীলন এবং কোচিংই বড় কারণ।
খাবারে একটু তারতম্য রয়েছে। থাইল্যান্ডের খাবারের স্বাদ ভালো লাগত না, ফল খেতাম। অল্প খেলেও সেটা শরীরে কাজে লাগত। বাংলাদেশের খাবার মুখে স্বাদ লাগলেও প্রোটিন কম। এজন্য ফেডারেশনের খাবারের বাইরেও মাঝে মধ্যে নিজেকে কিনে খেতে হয়।
ঢাকা পোস্ট : আপনি ১১ স্বর্ণ ও সাত রেকর্ড গড়লেও ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলে রৌপ্য পদক পেয়েছেন। ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলে দ্রুততম জলমানবের খ্যাতি পান আসিফ। গতকাল আসিফ রেজার সঙ্গে এই ইভেন্টে হারায় একটু আফসোস লাগছে নাকি?
রাফি : না তেমন আফসোস নেই। এই ইভেন্ট একটু বাড়তি আকর্ষণীয়। আসিফ ভাই এই ইভেন্টে ভালো। তারপরও আমি চেষ্টা করছি। যা হয়েছে এতে আমি সন্তুষ্ট।
ঢাকা পোস্ট : থাইল্যান্ডে উন্নত প্রশিক্ষণের পর মাহফিজুর রহমান সাগরেরও জাতীয় প্রতিযোগিতায় রেকর্ড ও স্বর্ণের ছড়াছড়ি ছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফে স্বর্ণ আসেনি। আপনাকে দিয়ে এখন আশা বাংলাদেশের। সেটা কি পূরণ হওয়ার মতো?
রাফি : আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাকে নিয়ে আশা করা যায়। এই বছরই মালয়েশিয়ান ওপেনে স্বর্ণ জিতেছি। ৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে টাইমিং ২৫ সেকেন্ডের ঘরে এনেছি। এবার ২৫.৯০ টাইমিং করেছি। সাফ গেমসে ২৫.৭০ সেকেন্ড টাইমিংয়ে স্বর্ণপদক পায়। আমার লক্ষ্য থাকবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেটা স্পর্শ করা।
ঢাকা পোস্ট : ৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে আপনার টাইমিং ছিল ২৬ সেকেন্ডের বেশি। সেটা কমিয়ে এখন ২৫ এ এনেছেন এটা প্রশংসনীয়। তবে আপনার এই টাইমিং তো ইলেকট্রনিক নয়। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পাবে না
রাফি : হ্যাঁ, এটা খুব দুঃখজনক। অলিম্পিকের মতো আমরা সাঁতারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপও খেলি মূলত ওয়াইল্ড কার্ডেই। ৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক ইভেন্টে ২৫.৯৯ সেকেন্ড স্ট্যান্ডার্ড। এটা হলে সরাসরি বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপে খেলার জন্য যোগ্য। আমার টাইমিং ২৫.৯০ হ্যান্ড হলেও ইলেকট্রনিকে আশা করি ২৫.৯৯ এর মধ্যেই থাকবে। আমার লক্ষ্য অলিম্পিকেও সরাসরি খেলা। ২০২৮ লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকে ৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক ইভেন্ট রয়েছে। টাইমিংয়ে আরও উন্নতি করে আমি সরাসরি অলিম্পিক খেলতে চাই।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রায় সব অলিম্পিকেই বাংলাদেশের সাঁতারুদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। কেউই সরাসরি খেলতে পারেননি। আপনার এই লক্ষ্য কি পূরণযোগ্য?
রাফি : আমি এখন বেশ ভালো ফর্মে রয়েছি। আরও কয়েক বছর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে অবশ্যই সম্ভব অলিম্পিকে সরাসরি খেলা। আরচ্যার রোমান সানা, সাগর ও গলফার সিদ্দিক ভাই পেরেছেন আমি কেন পারব না। আমি সরাসরি খেলার স্বপ্ন দেখি এবং সেটা পূরণে চেষ্টা করব।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশের সাঁতারে কিংবদন্তী মোশাররফ হোসেন খান, এরপর মাহফিজুর রহমান সাগর, রুবেল রানা ও মাহফুজা খাতুন শিলার নাম আসে। তারা কেউ সরাসরি অলিম্পিকে খেলতে পারেননি। আপনি কি তাদের ছাড়িয়ে ইতিহাস লিখতে পারবেন?
রাফি : আপনি যাদের নাম বলেছেন তারা সবাই শুধু সাঁতারেই নয় দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সামগ্রিকভাবেই কিংবদন্তী। মোশাররফ স্যার এক গেমসে পাঁচটি স্বর্ণ জিতেছেন। সাগর ভাই আমার দৃষ্টিতে অনেক উঁচু মানের সাঁতারু। তাদের সঙ্গে কখনোই নিজেকে তুলনায় আনব না। তারা তাদের সময়ের সেরা তো বটেই সব সময়ের সেরাদের সেরার মতোই। আমি আমার সেরা সময় ও পরিশ্রম দিয়ে শুধু এই লক্ষ্যটাই পূরণ করতে চাই।
ঢাকা পোস্ট : অলিম্পিকে সরাসরি খেলতে হলে আপনার কী কী সহায়তা প্রয়োজন?
রাফি : প্রথমত উন্নত প্রশিক্ষণ। সেটা অনেকটা নিশ্চিত হচ্ছে। বিশ্ব সাঁতার ফেডারেশনের বৃত্তি প্রোগ্রামে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে আমি বাহরাইনে তিন বছরের প্রশিক্ষণ নেব। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কিছু টুর্নামেন্ট খেলা প্রয়োজন। সেই টুর্নামেন্ট খেলতে ফেডারেশনের সাপোর্ট প্রয়োজন। ফেডারেশনের আর্থিক সামর্থ্য কম, ফলে সরকার থেকে সহায়তা পেলে ভালো হয়। প্রশিক্ষণ, টুর্নামেন্ট অংশগ্রহণের পাশাপাশি ডায়েট বা আরও কিছু আনুষাঙ্গিক বিষয় ঠিক রাখতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : আসিফ রেজা, আরিফুল তারাও বেশ সম্ভাবনাময় সাঁতারু ছিলেন। আরিফ ফ্রান্সে বৃত্তি পেয়ে পরবর্তীতে সেখানেই থিতু হয়েছেন। নানা কারণে তারা নিজের সকল সম্ভাবনার পূর্ণরুপ দিতে পারেননি। আপনি নিজেকে শৃঙ্খলার সঙ্গে ধরে রাখতে পারবেন তো?
রাফি : অবশ্যই আমার নিজের ওপর জীবনে অনেক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এখন পর্যন্ত। থাইল্যান্ড এশিয়ার দেশ হলেও তাদের জীবনযাত্রা ইউরোপের মতোই। আমি কখনো খেলার বাইরে অন্য কিছু ভাবিনি। আমার ফোকাস পুরোটাই সাঁতারের ওপর।
ঢাকা পোস্ট : সারা বিশ্বে অলিম্পিয়ান কিংবা জাতীয় সাঁতারুদের অনেক সম্মান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাঁতারুদের সম্মান, সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার সেই অর্থে নেই। এটা আক্ষেপ লাগে কি না...
রাফি : কিছুটা খারাপ তো লাগেই। তবে এজন্য আমাদের ব্যর্থতাও রয়েছে। আমরা সেভাবে সাফল্য আনতে পারি না, আবার সাফল্য আনলেও সেটা ঠিকমতো ব্র্যান্ডিং করতে পারি না। নৌবাহিনী, আর্মি, বিকেএসপি ছাড়া সাঁতারুদের ক্ষেত্র কম। অন্য দেশে সাঁতারুদের লিগ হয়। সেখানে ক্লাব থেকে অর্থ পায় সাঁতারুরা। বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতি নেই। আমি মনে করি আগে সাঁতারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার ছিল। ফেডারেশন বিদেশি কোচ আনায় বেশ ভালো উন্নতি হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা থাকলে সাঁতারের ভবিষ্যৎ খানিকটা উজ্জ্বল।
ঢাকা পোস্ট : অলিম্পিয়ান কিংবা বড় মাপের সাঁতারুরা নির্দিষ্ট কয়েকটি ইভেন্ট করে। সেখানে আপনি এবার ১২ ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন। এটা বাড়তি চাপ কি না
রাফি : বড় মাপের সাঁতারুরা শুধু একটির (ফ্রিস্টাইল, ব্যাকস্ট্রোক, বাটারফ্লাই) ওপরই ফোকাস করেন। জাতীয় প্রতিযোগিতা সব ইভেন্টেই খেলতে হয়। এখানে স্বর্ণ, রেকর্ডের নানা বিষয় থাকে।
ঢাকা পোস্ট : ২০১৯ সালে জুনিয়র সাঁতার দিয়ে শুরু। এরপর ২০২১ সালে সিনিয়র। গত চার বছরে আপনি ত্রিশটির কাছাকাছি স্বর্ণ এবং এর অর্ধেক রেকর্ড গড়েছেন। ক্যারিয়ার শেষে স্বর্ণ ও রেকর্ড সংখ্যা কত দেখতে চান?
রাফি : শতাধিক স্বর্ণ জিততে চাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা মিলিয়ে। তিন বছর ধরে অনেক ইভেন্টে নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙছি। ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে সাগর ভাইয়ের রেকর্ড ভাঙতে পেরে এবার একটু বেশি তৃপ্ত। কয়েক বছর চেষ্টা করেছি পারিনি। সাগর ভাই আমার আইডল। আমি যখন ২০১৬ সালে ট্যালেন্ট হান্টে ইয়েস কার্ড পাই তখন সাগর ভাই রিও অলিম্পিকে যাচ্ছিলেন। তখন স্বপ্ন দেখেছিলাম অলিম্পিক খেলব। ২০২৪ সালে প্যারিস অলিম্পিক খেললাম।
ঢাকা পোস্ট : ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। আপনার মায়ের অনেক সংগ্রামের মধ্যে আপনার সাঁতারে আগমন হলো কীভাবে?
রাফি : মা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছে। আমি একমাত্র সন্তান। আমার জন্য মায়ের ত্যাগ অবদান অনেক। সাঁতারু হওয়ার লক্ষ্য সেভাবে ছিল না। রাজবাড়ীতে সাঁতারের ট্যালেন্ট হান্ট হয়। সেখানে ইয়েস কার্ড পাওয়ার পরই ধাপে ধাপে এগিয়ে যাই। আজকের রাফি হওয়ার পেছনে মা, মাহবুব স্যার, নৌবাহিনী, ফেডারেশন সবারই অবদান রয়েছে।
এজেড/এফআই