অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী অরুণ নন্দী
রণাঙ্গনে তখন মুক্তিবাহিনী প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে! লড়াই চলছে স্বাধীনতার। পাল্টা আক্রমণ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তাদের সঙ্গে তখন যোগ হয়েছে এ দেশীয় দোসর-রাজাকার। সব মিলিয়ে তখনও কেউ জানেন না কবে, কখন মুঠোবন্দি হবে স্বাধীনতা নামের সেই সোনার হরিণ! চলছে মৃত্যুর মিছিল আর বীর যোদ্ধাদের রক্তের স্রোতধারা।
ঠিক তখনই অস্থির হয়ে ওঠেন শান্ত-ধীর-স্থির ছোটখাটো মানুষটি। দেশের জন্য কিছু একটা করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে তার মন। কিন্তু সবাই তো আর অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারেন না। সবাইকে দিয়ে তো আর যুদ্ধ হয় না। তাই বলে দেশমাতৃকার এমন দুঃসময়ে কি বসে থাকা যায়? মানুষটি যখন অরুণ নন্দী তখন আর বসে থাকেন কি করে?
বিজ্ঞাপন
জলের বুকে দীর্ঘ সময় সাঁতার কেটে বিশ্বরেকর্ড গড়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়তে তৈরি হন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য এমন যুদ্ধের কথা ভাবতে থাকেন অরুণ।
তখন কলকাতার শরণার্থী শিবিরে তিনি। উদ্বিগ্ন অরুণ নন্দী তার চেনা পথেই হাঁটলেন। যুদ্ধের আগেই চাঁদপুরের এ মানুষটি সাঁতারের বিরল প্রতিভা দিয়ে নজর কেড়েছিলেন। জলের বুকে যেন তার বাড়ি!
বিজ্ঞাপন
তাই তো সেই সাঁতারকেই হাতিয়ার হিসেবে নিলেন তিনি। নিজের পরিকল্পনার কথা শোনাতে গেলেন দূরপাল্লার সাঁতারের কিংবদন্তি ব্রজেন দাসকে। স্বাধীনতার আগেই প্রথম এশিয়ান হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন ব্রজেন দাস। ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে পাকিস্তান সাঁতার দলের সদস্যও ছিলেন বিক্রমপুরের এ সাঁতারু। তার পরামর্শ বেশ কাজে দেবে। তাই তো এই ছুটে যাওয়া।
কাজেও দিল বেশ! অরুণ নন্দীর ইচ্ছার আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিলেন ব্রজেন দাস। বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত। বলে দিলেন কীভাবে দীর্ঘ সময় ভেসে থাকা যায় জলের বুকে। তারই অধীনে কলকাতার বৌবাজার জিমনেশিয়ামে কঠোর ট্রেনিংয়ে নামলেন অরুণ।
এর আগে দীর্ঘ সময় সাঁতার কাটার বিশ্বরেকর্ড ছিল বি সি মোরের। ৮৮ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট একটানা সাঁতরে এ বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন এই মার্কিন সাঁতারু। ওই রেকর্ডটা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন ১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর চাঁদপুরের বাগদী গ্রামে জন্ম নেওয়া বাংলার দামাল ছেলে অরুণ।
তার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টায়। ভেন্যু কলকাতা কলেজ স্কয়ারের পুকুর। এমন মহতী উদ্যোগের উদ্বোধন করলেন কলকাতায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার হোসেন আলী। সবার করতালির মধ্য দিয়ে জলে নামলেন অরুণ। পুকুর পাড়েই ম্যানেজার হিসেবে ছিলেন ব্রজেন দাস। দুর্ঘটনা থেকে অরুণ নন্দীকে বাঁচাতে ছিলেন ভারতের তিন সাঁতারু পিকে সরকার, দিলীপ দে ও পরেশ দত্ত।
৮টা ৩৫ মিনিটে শুরু করলেন সাঁতার। চলতে থাকল জলের বুকে ভেসে থাকা! পশ্চিমে সূর্য অস্ত গেলেও থামে না তার সংগ্রাম। অহর্নিশ চলতে থাকে জলের বুকে ঝাঁপাঝাঁপি!
শরীর এক সময় অবশ হয়ে আসতে থাকে। কিন্তু থামলে চলবে কি করে? মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বিশ্ববাসীর দৃষ্টি যে কাড়তেই হবে। পা আটকে আসতে চায়। গলা শুকিয়ে যায়। কিন্তু থামেন না অরুণ। থামতে পারেন না। কিন্তু আর কত? ১২ অক্টোবর রাত ২টা ৪০ মিনিটে এসে থামেন। শরীর নিস্তেজ হয়ে ওঠার আগে শুধুই বললেন, ‘জয় বাংলা’।
ততক্ষণে ঠিকই লক্ষ্য অর্জন হয়ে গেছে। কারণ স্টপ ওয়াচ জানায় ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট টানা সাঁতার কেটেছেন জলের মুক্তিযোদ্ধা অরুণ নন্দী। তাকে শুভেচ্ছা জানাতে ছুটে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। মহতী ওই বিশ্বরেকর্ডের সাক্ষী ছিলেন কিংবদন্তি নায়ক উত্তম কুমার ও অস্কার বিজয়ী চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়। সেই অনুভূতির কথা এভাবে বর্ণনা করছিলেন অরুণ, ‘৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার কাটার পর আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে জল থেকে তুলে নেন। তখন রাত ২টা ৩৫ মিনিট। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ঢেউ একটু একটু করে আমাকে দুলিয়ে দিতে থাকে। আমাকে বউবাজার ব্যায়াম সমিতির বিছানায় শুইয়ে দিলে আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই। গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে যাই। কোনো কিছু আর আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। কতক্ষণ যে অচেতন হয়ে ছিলাম, বলতে পারব না। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে যখন চোখ মেলি, কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হতে থাকে। আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন একজন সুন্দরী মহিলা। আমার দিকে তিনি হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এ কী মায়া, বিভ্রম নাকি মরীচিকা!’
বিশ্বরেকর্ড গড়ে এক লাখ রুপি পেয়েছিলেন অরুণ। তার পুরোটাই তিনি তুলে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গড়া তহবিলে। একই সঙ্গে দৃষ্টি কাড়েন বিশ্ববাসীর। জানিয়ে দেন বাংলাদেশ নাম নিতে যাওয়া বদ্বীপটি স্বাধীন হতে চায়।
যে মানুষটি জীবন বাজি নিয়ে গড়েছেন ওই রেকর্ড তাকে আমরা সম্মান দিতে বড্ড বেশি কার্পণ্য করেছি। অকৃতদার এই মানুষটি সাদামাটাভাবে জীবন কাটিয়ে গেছেন। এভাবেই ২০০৮ সালের ১৬ নভেম্বর চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা না করে শুধুই দিয়ে গেছেন অকৃপণ হাতে, তার পুরোটা জীবন। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী অরুণ নন্দী!
এটি/এনইউ