হেলমেট নিয়ে ফ্যাশন : একটি ভুলই হতে পারে জীবনের শেষ ভুল!

নিরাপত্তার চেয়ে ‘স্টাইল’ যেন এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ— বিশেষ করে তরুণ বাইকারদের মাঝে। দামি বাইক, চমকদার জ্যাকেট, স্লিক গ্লাভস— সবই ঠিক, কিন্তু মাথায় যে হেলমেট, তা কি সত্যিই জীবন বাঁচানোর যোগ্য? ভেবেছেন কি কখনো। তা, ছাড়া অনেকে তো হেলমেট ফ্যাশন করে মাথায় না দিয়ে বাইকের সামনে ঝুলিয়ে রাখেন। কিন্তু একটা ভুল হেলমেটই হতে পারে জীবনের শেষ ভুল।
কারণ, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা যে কোনো সময় ঘটতে পারে, আর তখন আপনার জীবনের একমাত্র রক্ষাকবচ হলো একটি মানসম্মত হেলমেট। হেলমেট যদি সঠিক মাপের না হয়, উপযুক্ত মানদণ্ড মেনে তৈরি না হয়, অথবা নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে তা কেবল একটি শো পিস হিসেবেই থেকে যায়, কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারে না। দুর্ঘটনার সময় আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, মস্তিষ্ককে রক্ষা করতে ব্যর্থ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট শুধু জরিমানার হাত থেকে বাঁচার জন্য নয়, বরং আপনার জীবনের সুরক্ষায় সবচেয়ে জরুরি একটি অনুষঙ্গ। তাই ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করা প্রতিটি রাইডারের জন্য অত্যাবশ্যক।
হেলমেট নয়, প্লাস্টিক কভারের ফাঁদ!
দোকানে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় মেলে চকচকে ‘হেলমেট’। বাহ্যিকভাবে দেখতে ‘প্রিমিয়াম’, কিন্তু আসলে এগুলোতে থাকে না কোনো ISI, DOT বা ECE সার্টিফিকেশন। ভেতরের ফোমও কমদামি থার্মোকল। দুর্ঘটনার সময় এসব হেলমেট প্রতিরক্ষা তো দূরের কথা, আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
দুঃখজনকভাবে, অনেক বাইক চালক এখনো দামের কথা চিন্তা করে নিম্নমানের বা নকল হেলমেট ব্যবহার করেন। তারা হয়তো জানেন না, এই সস্তা হেলমেটগুলো মারাত্মক দুর্ঘটনায় মাথাকে সামান্যতম সুরক্ষাও দিতে পারে না। একটি ভাঙা বা ফাটল ধরা হেলমেট, কিংবা মাথায় ঠিকভাবে না বসা হেলমেটও একই রকম বিপজ্জনক।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিনই আমরা নকল হেলমেট পরা রাইডারদের দেখি। তারা জানেই না এগুলোর কোনও সেফটি স্ট্যান্ডার্ড নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে ISI বা DOT স্ট্যান্ডার্ড নিশ্চিত হেলমেটগুলোই আইনত বৈধ। কিন্তু নিম্ন আয়ের বাইকাররা অথবা ‘দেখতে সুন্দর’ চায় এমন তরুণরা প্রায়ই এই সেফটি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
মোটরসাইকেল হেলমেটের সার্টিফিকেশন
হেলমেটের নিরাপত্তা মান বোঝাতে বিভিন্ন সংস্থা সার্টিফিকেশন প্রদান করে। যেমন:
DOT (Department of Transportation): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মান।
ECE (Economic Commission for Europe): ইউরোপীয় ইউনিয়নের মান। ECE 22.06 বর্তমানে অন্যতম নিরাপদ হিসেবে পরীক্ষিত।
Snell: অত্যন্ত কঠোর মান, সাধারণত রেসিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়।
SHARP (Safety Helmet Assessment and Rating Program): যুক্তরাজ্যের ৫-স্টার রেটিং সিস্টেম।
ISI (Indian Standards Institute): ভারতীয় মান, তবে আন্তর্জাতিকভাবে DOT বা ECE বেশি গ্রহণযোগ্য।
সাধারণ বাইকারদের জন্য DOT অথবা ECE সার্টিফাইড হেলমেট সহজলভ্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে সুপারিশকৃত।
সঠিক মাপ নির্ধারণ
সার্টিফাইড হেলমেট কিনলেই হবে না, সঠিক মাপের হেলমেট পরা জরুরি।
একটি মেজারিং টেপ কপালের সামনে (ভ্রুর ঠিক উপরে) রেখে মাথার সবচেয়ে চওড়া অংশ দিয়ে ঘুরিয়ে সেন্টিমিটারে মাপ নিন।
প্রতিটি ব্র্যান্ডের নিজস্ব সাইজ চার্ট থাকে, সেই অনুযায়ী আপনার মাপের হেলমেট নির্বাচন করুন।
হেলমেট পরে দেখুন এটি snug fit কিনা – অর্থাৎ খুব বেশি টাইট বা ঢিলা হওয়া উচিত নয়। মাথা ঝাঁকিয়ে দেখুন যেন হেলমেট সরে না যায়।
বাংলাদেশে GearX, MT, Yohe, LS2, Bilmola, Vega, Axor, Axxis সহ আরও অনেক ব্র্যান্ডের সার্টিফাইড হেলমেট পাওয়া যায়, যার দাম ৩০০০ টাকা থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
রাইডারভেদে উপযোগী হেলমেট
শহরের মধ্যে স্বল্প গতিতে রাইডের জন্য: হাফ ফেস হেলমেট আরামদায়ক হতে পারে।
লং রাইড ও দীর্ঘ সময় ব্যবহারের জন্য: ফুল ফেস হেলমেট নিরাপদ। মডিউলার হেলমেট উভয় ক্ষেত্রেই স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা দেয়।
উচ্চ গতির রাইডিং বা রেসিংয়ের জন্য: এরোডাইনামিক ডিজাইন এবং লাইটওয়েট রেসিং হেলমেট (কেভলার ও কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি) আবশ্যক।
অফ-রোডের জন্য: ধুলা, মাটি ও পাথরের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার জন্য ডার্ট হেলমেট ভালো সাপোর্ট দেয়।
প্রিয় বাইকার, সব সময় সার্টিফাইড হেলমেট ব্যবহার করুন এবং নিরাপদে রাইড করুন! আপনার জীবনের মূল্য অপরিসীম।
শেষ কথা একটা ভুল হেলমেটই হতে পারে জীবনের শেষ ভুল—এই কথাটা যেন শুধু স্লোগান না হয়ে ওঠে, বরং প্রতিটি রাইডার যেন সেটা মনেপ্রাণে বুঝতে পারে। কারণ, দুর্ঘটনা কখনও বলে আসে না—কিন্তু প্রস্তুতি থাকলে প্রাণটা অন্তত বাঁচে।
আপনার বাইক রাইডিং নিরাপদ হোক!
প্রসঙ্গত, ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক ডাক্তার এরিক গার্ডনার মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত মোটরসাইকেল চালকদের দেখে হেলমেট তৈরির ধারণা দেন। প্রথমে বিরোধিতা এলেও, রেসিং ইভেন্টে হেলমেট বাধ্যতামূলক করার পর এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়। ১৯৩৫ সালে হেলমেট ব্যবহারের জন্য প্রথম আইন তৈরি হয়। ১৯৫০ এর দশকে বাণিজ্যিকভাবে হেলমেট উৎপাদন শুরু হয় এবং বেল ৫০০ মডেল বর্তমান হেলমেটের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত। সময়ের সাথে সাথে হেলমেটের উপাদান ও ডিজাইন উন্নত হয়েছে। সূত্র- Motorcyclist Online, bell helmet, bikebd
এমজে