যে সামান্য ভুলে ইঞ্জিন সিজ হয়, খরচ হয় লাখ টাকা!

ধরুন, আপনি নিশ্চিন্তে বাইক চালাচ্ছেন, হঠাৎ আপনার বাইক থেমে গেল। না, পেট্রোল শেষ হয়নি, ইঞ্জিন হঠাৎ বিকল হয়ে গেছে! ভাবুন, আপনি হাইওয়েতে বা কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় এ অবস্থায় আটকে পড়েছেন, আর আপনার বাইকটি এমনভাবে লক হয়ে আছে যে ঠেলে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। বাইকারদের জন্য যে এটি সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন ও আতঙ্ক, তা আর বলার বাকি রাখে না। কারণ, ইঞ্জিন সিজ এর মতো এমন পরিস্থিতিতে সেবা বা মেকানিক খুঁজে বের করা হয়ে ওঠে বিশাল এক ঝক্কি; তারপরের খরচ তো আছেই।
শুনতে ভয়ংকর লাগলেও, বাইকারদের এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ, একটি সাধারণ ভুল অনেক সময় বাইকের ইঞ্জিনকে চিরতরে অচল করে দিতে পারে। ইঞ্জিন সিজ হওয়া মানে- ইঞ্জিনের ভেতরের অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশগুলো অত্যধিক তাপ ও ঘর্ষণের কারণে একসঙ্গে আটকে যায়, যার ফলে বাইক সম্পূর্ণভাবে স্থবির হয়ে পড়ে। এবার জেনে নেওয়া যাক সেই ছোট ছোট ভুলগুলো কী, যা বাইকারদের অজান্তেই মারাত্মক বিপদে ফেলে দিতে পারে।
ইঞ্জিন সিজ হওয়ার প্রধান কারণগুলো
একটি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন সিজ হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকে। সময়মতো এগুলো শনাক্ত করতে পারলে বড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
ইঞ্জিন অয়েলের ঘাটতি বা কার্যকারিতা হারানো: এটি ইঞ্জিন সিজ হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। নিয়মিত ইঞ্জিন অয়েল না বদলালে অথবা এর পরিমাণ কমে গেলে, এটি তার লুব্রিকেশনের ক্ষমতা হারায়। ফলে ইঞ্জিনের ভেতরের ধাতব অংশগুলো একে অপরের সঙ্গে সরাসরি ঘষা খেতে শুরু করে, যা এক পর্যায়ে লক হয়ে যায়।
অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া: দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ গতিতে বাইক চালালে, অথবা কুলিং সিস্টেমে সমস্যা থাকলে ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত তাপ পিস্টন ও সিলিন্ডারের মধ্যে থাকা লুব্রিকেশন নষ্ট করে দেয়, ফলে ইঞ্জিনের অংশগুলো একে অপরের সঙ্গে আটকে যায়।

আরও পড়ুন
নিম্নমানের বা ভুল গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার: প্রতিটি বাইকের ইঞ্জিনের জন্য নির্দিষ্ট গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল প্রয়োজন হয়। যদি ভুল গ্রেডের বা নিম্নমানের অয়েল ব্যবহার করা হয়, তবে তা ইঞ্জিনকে সঠিকভাবে সুরক্ষা দিতে পারে না। এর ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায় এবং ইঞ্জিন সিজ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
ফুয়েল মিশ্রণে ত্রুটি: ফুয়েল সিস্টেমে (কার্বুরেটর বা ইনজেকশন) কোনো সমস্যা থাকলে জ্বালানি ও বাতাসের সঠিক মিশ্রণের তারতম্য ঘটতে পারে। যদি মিশ্রণে জ্বালানির পরিমাণ কম থাকে, তবে ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়; যা শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিন সিজের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
দীর্ঘ সময় বাইক অব্যবহৃত থাকা: বাইক যদি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকে, তাহলে ইঞ্জিনের ভেতরের অয়েল শুকিয়ে যায় এবং মরিচা ধরতে শুরু করতে পারে। এরপর যখন বাইক আবার চালু করার চেষ্টা করা হয়, তখন ইঞ্জিন সহজে ঘুরতে না পেরে সিজ হয়ে যেতে পারে।

ইঞ্জিন সিজ হওয়া থেকে বাঁচতে প্রতিকার
ইঞ্জিন সিজ হওয়া যেমন ভোগান্তি, তেমন ব্যয়বহুল ব্যাপার; তাই এর প্রতিকার জরুরি।
নিয়মিত ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন: বাইকের ম্যানুফ্যাকচারারের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতি ১০০০-১২০০ কিলোমিটার পর অথবা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অবশ্যই ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করুন। এটি ইঞ্জিনের কার্যকারিতা বজায় রাখে এবং ঘর্ষণ কমায়।
সঠিক গ্রেড ও মানের অয়েল ব্যবহার: আপনার বাইকের ম্যানুয়াল চেক করে সঠিক গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করুন। স্থানীয় মেকানিকের পরামর্শের চেয়ে বাইক প্রস্তুতকারকের নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। কম দামের লো-গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল থেকে দূরে থাকুন।
কুলিং সিস্টেমের যত্ন নিন: যদি আপনার বাইক লিকুইড কুলড হয়, তবে নিয়মিত কুল্যান্টের মাত্রা পরীক্ষা করুন। যদি এয়ার কুলড বাইক হয়, তবে ইঞ্জিনের ফিনগুলো সবসময় পরিষ্কার রাখুন, যাতে বাতাস চলাচল বাধাগ্রস্ত না হয়।
বাইক চালানোর সঠিক অভ্যাস গড়ে তুলুন: নতুন বাইকের ক্ষেত্রে ‘ব্রেক-ইন পিরিয়ড’ মেনে চলুন এবং হঠাৎ করে অতিরিক্ত রেভ বা গতি তুলবেন না। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ আরপিএম-এ (RPM) বাইক চালানো থেকে বিরত থাকুন।
অব্যবহৃত বাইকের যত্ন নিন: যদি আপনার বাইক দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার পরিকল্পনা থাকে, তবে অন্তত সপ্তাহে একবার বাইকটি স্টার্ট দিয়ে কিছুক্ষণ চলতে দিন। এতে ইঞ্জিনের ভেতরে অয়েল সার্কুলেট হবে এবং মরিচা পড়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
অস্বাভাবিক শব্দে মনোযোগ দিন: যদি বাইকের ইঞ্জিন থেকে টিকটিক বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পান, তবে তা উপেক্ষা করবেন না। এটি অনেক সময় ইঞ্জিন সিজ হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। দ্রুত একজন অভিজ্ঞ মেকানিকের কাছে যান এবং সমস্যাটি সমাধান করুন।
উল্লেখ্য, যেসব বাইকার ইঞ্জিন সিজ হওয়ার পর মেরামতের খরচ সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, তারা প্রায়শই হতবাক হয়ে যান। মেরামতের জন্য বাইক যখন মেকানিকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন পিস্টন, সিলিন্ডার ব্লক, ক্র্যাংকশ্যাফট, কানেক্টিং রড— এমন অনেক দামি যন্ত্রাংশ বদলানোর প্রয়োজন পড়ে।

একটি ১৫০ সিসি বাইকের ক্ষেত্রে এসব পার্টস কিনতে এবং মেকানিকের মজুরি দিতে মোট খরচ দাঁড়াতে পারে ১৫,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা বা তারও বেশি। এই বিপুল পরিমাণ খরচ দেখে অনেক বাইকার হতাশ হয়ে পড়েন। আবার এত টাকা খরচ করে মেরামত করার চেয়ে একটি নতুন ইঞ্জিন কেনাই অনেকে সহজ মনে করেন। ফলে মডেল ও ব্র্যান্ডভেদে একটি নতুন ইঞ্জিন কিনতে ৩০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
খরচ কমাতে অনেকে সেকেন্ড হ্যান্ড ইঞ্জিনের খোঁজ করেন। তবে এই ধরনের পুরোনো ইঞ্জিন সব জায়গায় সহজে পাওয়া যায় না। এর জন্য ঢাকার বংশালের মতো নির্দিষ্ট কিছু মার্কেটে যেতে হতে পারে,ঝক্কি বৈ কি। সে কারণেই বলা হচ্ছে, সামান্য অবহেলায় ইঞ্জিন সিজের কারণে হতে পারে লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতি।
ডিএ