এবার যুক্তরাজ্যে পালিয়ে গেলেন সিভিল এভিয়েশনের লাইব্রেরিয়ান
যুক্তরাজ্যে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য ছুটি নিয়েছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) লাইব্রেরিয়ান তানিয়া আক্তার। এরপর আর ফেরেননি। ছুটি চাওয়ার আগে কখনো নিজের অসুস্থতার কথা বলেছেন, কখনো বলেছেন প্রয়োজন ‘কমপ্লিট বেড রেস্ট’। ছুটি বাড়াতে প্রেগন্যান্সি লিভ নিয়েছেন। এরপর সেই ছুটি শেষেও ফেরেননি। সর্বশেষ অজুহাত দিয়েছেন ‘মেয়ের পাসপোর্ট হয়নি’। দীর্ঘ ১৯ মাস চিঠি চালাচালির পর তাকে বরখাস্ত করা হয়।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, বেবিচকের গ্রন্থাগারিক (লাইব্রেরিয়ান) হিসেবে চাকরি করতেন তানিয়া। এটি আইন শাখার অধীনে ছিল। ২০২১ সালের ২ জুন চারমাসের ছুটি চেয়ে আবেদন করেন তানিয়া। ছুটির কারণ হিসেবে তিনি জানান, যুক্তরাজ্যে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করবেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চারমাসের জায়গায় দুইমাসের ছুটি মঞ্জুর করে বেবিচক। এরপর একই বছরের ১৪ জুন তিনি যুক্তরাজ্যে যান।
তবে আগস্টে ছুটি শেষে না ফিরে যুক্তরাজ্য থেকে বেবিচককে চিঠি পাঠান তানিয়া। চিঠিতে তিনি নিজেকে ‘গর্ভবতী’ বলে দাবি করেন। ১৮ আগস্ট পাঠানো সেই চিঠিতে তানিয়া বেবিচককে জানান, তিনি গর্ভবতী ও শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ। সেখানকার চিকিৎসক তাকে ৬/৭ মাস বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন। সে কারণে চিঠিতেই তিনি ছুটি বাড়ানোর অনানুষ্ঠানিক আবেদন জানান। তবে ছুটির আবেদন প্রক্রিয়া না মেনে চিঠিতে ছুটি চাওয়ায় তা মঞ্জুর করা করেনি বেবিচক। বরং দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ তার বিরুদ্ধে ‘পলায়ন’র অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। পাশাপাশি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সশরীরে উপস্থিত হয়ে মামলার শুনানিতে অংশ নিতে ইচ্ছুক কি না তা জানাতে বলা হয়।
বেবিচকের এই চিঠি তাদের ওয়েবসাইট, তানিয়ার ব্যক্তিগত ই-মেইল অ্যাড্রেস, তানিয়ার বাংলাদেশের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা এবং তার যুক্তরাজ্যের ঠিকানায় পাঠানো হয়।
বেবিচক জানায়, ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল তানিয়া ফিরতি ইমেইলে ‘সশরীরে উপস্থিত থাকা সম্ভব না’ বলে জানান। এরপর এই মামলায় একজন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে তানিয়া ‘পলায়ন’ করেছেন বলে প্রমাণিত হয়। সেদিনই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে বেবিচক। এছাড়া পাশাপাশি তাকে দ্বিতীয় দফায় একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। সেটির উত্তর ৭ কার্যদিবসের মধ্যে দিতে বলা হয়। পরে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তানিয়া তার উত্তরে ‘কন্যা সন্তানের পাসপোর্ট হাতে পাইনি বলে দেশে ফিরতে পারিনি’ এমনটি উল্লেখ করেন।
তবে তানিয়ার উল্লেখিত এই কারণ যুক্তিযুক্ত না হওয়ায় তাকে চূড়ান্তভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এ বছরের মার্চের ৮ তারিখ তাকে বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেন বেবিচকের সদস্য (প্রশাসন) অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব আলম তালুকদার।
প্রজ্ঞাপনে এতে বলা হয়, তানিয়া আক্তার যুক্তরাজ্য গিয়ে এতদিন ওই দেশে অবস্থান করায় সত্যিই সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তিনি দূতাবাসের মাধ্যমেও ছুটি বাড়ানোর কোনো আবেদন করেননি। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ-এর কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১ এর ৪৯(গ) বিধি অনুযায়ী তাকে ‘পলায়ন’র দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তার প্রতি গুরুদণ্ড আরোপপূর্বক বিভাগীয় মামলাটি নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বেবিচকের কাছ থেকে ছুটি নেওয়ার সময় যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজে লিওনার্দো ক্লোজ নামে একটি এলাকায় থাকার ঠিকানা ও একটি মোবাইল নম্বর দিয়েছিলেন তানিয়া। তবে সেটি আদৌ সঠিক কি না এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি বেবিচক।
‘পালিয়েছেন’ বেবিচকের আরও ৩ কর্মকর্তা
এর আগেও বেবিচকের দুই কর্মকর্তা বিদেশে পলায়ন করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। আরেকজন নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের হদিস পাচ্ছে না বেবিচক। বিদেশে পলায়নকারীদের মধ্যে একজন বেবিচকের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. শহীদুজ্জামান। তিনি ২০২১ সালের শুরুর দিকে ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। একাধিকবার নোটিশ দিয়েও তাকে কর্মস্থলে ফেরত আনা যায়নি। বাধ্য হয়ে শহীদুজ্জামানকে বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে বেবিচকের বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত ১০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।
বেবিচকের আরেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল খালেকও কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ ছিল। তাকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করে বেবিচক।
এছাড়া যশোর বিমানবন্দরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলমকেও খুঁজে পাচ্ছে না বেবিচক। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাঁচদিনের নৈমিত্তিক ছুটি (ক্যাজুয়াল লিভ) নিয়ে নিজ বাড়ি পাবনায় যান মাহবুব। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও আর কর্মস্থলে ফেরেননি। এ বিষয়ে ২২ নভেম্বর তাকে নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য তলব করে বেবিচক। পরে তার বাসায় চিঠি পাঠানো হয় ও হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দেওয়া হয়। সেসময় তাকে সাতদিনের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হলেও তিনি আসেননি।
এআর/কেএ