‘পকেট কমিটি’তে গতি হারাবে ঢাবি ছাত্রদল, শঙ্কা নেতাকর্মীদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রদলের সদ্য ঘোষিত কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন এমন অনেককে কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে।
অনেকের মতে, এটি ছাত্রদল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের 'পকেট কমিটি' হয়ে গেছে। এ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে ঢাবি ছাত্রদলকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। এছাড়া ডাকসু নির্বাচনের পর থেকে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের যে অবস্থান এ কমিটি কার্যকর হলে সেটা হারাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাবি ছাত্রদলের ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অনুমোদন দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী খোরশেদ আলম সোহেলকে সভাপতি এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে কমিটিতে। এই কমিটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতাকর্মীদের বিভিন্ন গ্রুপে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
আরও পড়ুন : কমিটিতে আমার নাম ভুলে এসেছে : ঢাবি ছাত্রদল নেত্রী
কমিটিতে পদবঞ্চিত এবং প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া একাধিক নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের লোক আনতে গিয়ে ঢাবি ছাত্রদলের নেতৃত্ব তুলে দিয়েছে বিতর্কিতদের হাতে। সংগঠনের সভাপতিসহ কমিটির অনেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেকে দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সক্রিয় ও পরিচিত মুখদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
নতুন কমিটির সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ২০১৬ সালের পর প্রায় তিন বছর রাজনীতিতে নিষ্ক্রীয় ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ (এফ রহমান হল), যুগ্ম সম্পাদক নাছির উদ্দিন শাওনের একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যদিও তারা এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন।
এছাড়া সহ-সভাপতি মশিউর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক ইউসুফ হোসেন খান, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাসুদুর রহমান বাবু, সহ-সাধারণ সম্পাদক আফছার উদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে নেতাকর্মীদের অনেকে দাবি করেছেন।
আরেক সহ সাধারণ সম্পাদক মুন্সি সোহাগ মাত্র ছয় মাসের রাজনীতিতে বড় ভাইয়ের কল্যাণে দুটি পদ লাভ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যক্তি আক্রোশের শিকার হয়ে পরিশ্রমী নেতা জগন্নাথ হলের সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় শান্ত, মুহসীন হলের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম, জিয়া হলের সভাপতি তারেক হাসান মামুন, সাবেক আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আব্দুর রহিম রনি, সাকিব ইসলাম এবং শাহিনুর ইসলামসহ আরো বেশ কয়েকজন ত্যাগী ও পরিশ্রমী নেতার কমিটিতে স্থান হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবি ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ছাত্রদলের সবচেয়ে অযোগ্য কমিটি সম্ভবত এটিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য ও সক্ষম নেতৃত্ব আমরা আশা করছিলাম। নিজেদের বলয় শক্তিশালী করতে গিয়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ঢাবি ছাত্রদলকে একরকম অকার্যকর করে দিয়েছে। কমিটি গঠনের পর এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসে মুভ করতে পারেননি তারা। স্বাগত মিছিলে মাত্র ১০-১৫ জন নেতাকর্মী উপস্থিত হয়েছিল, যা তাদের অযোগ্যতা প্রমাণ করে।
নতুন কমিটির একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও কমিটি নিয়ে অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিটিতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী ছাড়া তেমন কাউকে পদ দেওয়া হয়নি। ত্যাগী, পরিশ্রমী ও যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কমিটিতে অনেকের জায়গা হয়নি। আমরা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত মামলা হামলার শিকার হচ্ছি অথচ নিজ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাদের সাথে স্বৈরাচারী আচরণ করছে। আমার মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যে গতি ছিল সেটি আর থাকবে না। নিজ হাতেই সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব সেটা ধ্বংস করছে।
নবগঠিত কমিটির সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ছাত্রলীগ করতাম এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ছাত্রদল করার কারণে আমাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। নেতা হতে না পেরে অনেকে হতাশা, অভিমান থেকে হয়তো এসব কথা বলে বেড়াচ্ছেন। যোগ্য মনে করেই সংগঠন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে।
সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, যারা অভিযোগ দিচ্ছে আমি ছাত্রলীগ করতাম, নিষ্ক্রিয় ছিলাম, তারা যদি প্রমাণ দিতে পারে তাহলে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করব। ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত হয়েই আমাকে হল ছাড়তে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদলের রাজনীতিতে আমি সক্রিয়। আমরা দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টর স্যারের সাথে দেখা করব এবং ক্যাম্পাসে মুভ করব। এরপর আমরা কমিটি বর্ধিত করব। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অবশ্যই ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে।
ঢাবি ছাত্রদলের সদ্য সাবেক আহবায়ক আখতার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিটিতে অপরাপর গ্রুপের নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। নতুন কমিটি কতটুকু স্মুথলি পারফর্ম করতে পারবে সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রদল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের আস্থা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কমিটি হয়। দলের জন্য ত্যাগ ও পরিশ্রমসহ সবকিছু বিবেচনা করে ঢাবি ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আশাকরি পূর্বের কমিটির চেয়ে এই কমিটি ভালো করবে। আর দেশের এমন পরিস্থিতিতে কেউ ছাত্রলীগ থেকে এসে ছাত্রদল করবে আর সরাসরি নেতৃত্বে এসে যাবে, এমনটি হতেই পারে না।
এইচআর/জেএস