মৃত্যুর পরও টনক নড়েনি, সাইনবোর্ডে দায় সেরেছে ঢাকা কলেজ প্রশাসন

ঢাকা কলেজের পুকুরের পানিতে ডুবে বহিরাগত এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পরও টনক নড়েনি কলেজ প্রশাসনের। ‘বহিরাগতাদের পুকুরে গোসল করা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ’ এটুকু লিখেই দায়িত্ব শেষ করেছেন তারা। কিন্তু এই নির্দেশনার কোনও তোয়াক্কাই করছেন না বহিরাগতরা। আর কলেজ প্রশাসনও বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশ কিংবা গোসল ঠেকাতে নেয়নি নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ঢাকা কলেজের পুকুরে গোসল করতে নেমে পানিতে ডুবে মারা যান রাশিদুল হাসান ইমন নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি রাজধানীর বনশ্রী আইডিয়াল কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে রামপুরা বনশ্রী থেকে ঢাকা কলেজে বেড়াতে এসে পুকুরে গোসল করতে নেমে পানিতে তলিয়ে যান। এরপর তার সঙ্গের বন্ধুরা বিষয়টি কলেজের অন্যান্যদের জানালে স্নাতক পড়ুয়া কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থী সন্ধ্যার পর ৪৫ মিনিটের চেষ্টায় পানিতে ডুব দিয়ে ১ নম্বর ঘাটের কাছে প্রায় ১৫ ফুট পানির নিচ থেকে তাকে উদ্ধার করে। তাৎক্ষণিক অধ্যক্ষের গাড়িতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি।
এই ঘটনার পর ঢাকা কলেজের পুকুরে বহিরাগতদের অবাধ গোসলের বিষয়টি সামনে আসে। ফলশ্রুতিতে পরদিন বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বহিরাগতদের গোসল নিষেধ জানিয়ে নির্দেশনা টানানো হয়। তবে একদিনও মানা হয়নি এই নির্দেশনা।
শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালেই দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। আবারো আশেপাশের বহিরাগতদের দল বেঁধে পুকুরে গোসল করতে দেখা যায়। যাদের অধিকাংশই শিশু এবং কিশোর। এর মধ্যে আবার সাঁতারও জানেন না অনেকেই। নেই কোনও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা অথবা অভিভাবক কিংবা বড় কোনও মানুষজনও। যার ফলে আবারো প্রাণহানির মতো চরম দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ৯টার দিকে কলেজের মাঠে ফুটবল খেলার পর পুকুরের ১ নম্বর ঘাটে দুরন্তপনায় মেতেছে ৫ কিশোর। এরমধ্যে ২ জন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর, ২ জন ৫ম শ্রেণীর ও ১ জন ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। সবাই ঢাকা কলেজের পাশের একটি স্কুলেই পড়াশোনা করে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই সাঁতার জানেন না।
এই ঘাটে গত ২ দিন আগে পানিতে ডুবে একজন মারা গেছে এই খবর জানা আছে কি না জানতে চাইলে তারা উত্তর দেয়— আমরা তো পানিতে নামিনি, সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই গোসল করছি।
ঢাকা কলেজের বেশ কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থীরা সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, পুকুরে আবাসিক শিক্ষার্থীরা যতটা নামেন তার চেয়ে বেশি আশপাশের বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছোট ছোট বাচ্চা, কিশোররা নামে। এদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৯৫ জনই আবার সাঁতার জানে না। শখের বসে কিংবা বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই গোসল করতে পুকুরে নামে। অনেক সময়ই দেখা যায় অনেককে পানিতে হাবুডুবু খেতে, তখন কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধার করেন। সাঁতার শেখা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ নিরাপদ উপায়ে হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
সাব্বির আহমেদ শুভ নামের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা (আবাসিক শিক্ষার্থীরা) অধিকাংশই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ুয়া। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই সাঁতার জানেন। একান্ত প্রয়োজন, শরীরচর্চার উদ্দেশ্য, কাপড় ধোয়া বা নিতান্তই শখের বশে একসঙ্গে বন্ধুরা মিলে পুকুরে সাঁতার কাটতে নামি। আবার যদি কেউ সাঁতার না জানে তার প্রতি খেয়াল রাখি। কিন্তু বাইরে থেকে আসা ছোট শিক্ষার্থীরা অনেকসময়ই দুষ্টামির ছলে তাদের বন্ধুদের পানির দিকে ঠেলে দেয়। বড় শিক্ষার্থীরা আশপাশে থাকলে প্রায়শই তাদের এসব করতে নিষেধ করি।
তিনি বলেন, সাঁতার শেখার প্রয়োজন হলে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়ে অথবা অভিভাবকের উপস্থিতিতে পানিতে নামা উচিত। আর দুর্ঘটনা রোধে কলেজ প্রশাসনকেও কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। শুধু সাইনবোর্ড টানিয়েই দায়িত্ব শেষ না করে আবাসিক এলাকায় প্রবেশের গেটে ২৪ ঘণ্টা পর্যায়ক্রমে নিরাপত্তারক্ষী নিশ্চিত করতে হবে।
সাব্বির হাসান নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কলেজ প্রশাসন কড়াকড়ি আরোপ না করবে এই ঝুঁকি থেকেই যাবে। সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সেজন্য এ ধরনের প্রাণহানি রোধে অবশ্যই কলেজ প্রশাসনকে আরো কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিষয়টি ছোট করে বা হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অধিকাংশ সময়ই আমরা দেখি ছোট বাচ্চারা আসে। তারা হয়তো আবেগে এবং বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পুকুরে নেমে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই পুকুরের গভীরতা, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ অনেক বেশি। সেজন্য সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করাটা জরুরি।
এসব বিষয়ে ঢাকা কলেজ উপাধ্যক্ষ এবং ছাত্রাবাস কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এ.টি.এম. মইনুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বহিরাগত এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার পর আমরা ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। আসলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকজন আসেন। কারা বহিরাগত আর কারা শিক্ষার্থী সেটিও নিরূপণ করা একটু কঠিন হয়ে যায়। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা আগের চেয়েও যত্নবান হয়েছি।
বহিরাগত শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা কেউ চায়নি। আমরা সব সময় খেয়াল রাখার চেষ্টা করি যখনই আমাদের চোখে ছোট বাচ্চারা পড়ে অথবা বহিরাগত কেউ পড়ে তাদেরকে পুকুর থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, ছাত্রাবাস তত্ত্বাবধায়ক, নিরাপত্তা রক্ষী ও কর্মচারীদের কঠোর মনিটরিং এর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এমএসএ