গাছপালা-জলাভূমি থাকায় জাবিতে গরম কম, অনলাইনে ক্লাসের তোড়জোড় নেই
টানা আটাশ দিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তীব্র গরমে কয়েকদিন স্কুল বন্ধ থাকার রোববার থেকে স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অনলাইন ক্লাস। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস চালুর দাবি উঠছে। ঠিক তখনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা চলমান রয়েছে। জাবি শিক্ষার্থীরা বলছেন, গরমের অজুহাত দিয়ে যাতে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ কিংবা অনলাইনে করা না হয়। এতে পিছিয়ে পড়বেন শিক্ষার্থীরা।
বিপরীতমুখী এ আবহাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের একদল গবেষক গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন। গবেষণা দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল ইসলাম।
গবেষণায় উঠে এসেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে নানা ধরনের বৃক্ষ। এ ছাড়া ২২ শতাংশে রয়েছে জলাশয়। এসব বৃক্ষ ও জলাশয়ের কারণে দেশে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের সময়েও তুলনামূলক কম তাপমাত্রা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ গবেষণায় ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএস ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও ঢাকা শহরে গ্রীষ্মকালের শুরু থেকে দেড় মাসের তাপমাত্রার পার্থক্য পরিমাপ করেছে। যেখানে ঢাকার চেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপমাত্রা কম ছিল।
প্রতি বছর ১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিলে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাকে বিবেচনায় নিয়ে দেখা যায়, ২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগরের গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি। ২০২২ সালে জাবিতে ছিল ৩৪ ডিগ্রি ও ঢাকায় ছিল ৩৭.২৬ ডিগ্রি, এ ছাড়া ২০২৩ সালে তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩৭ ডিগ্রি ও ৩৮ ডিগ্রি। চলতি বছরের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা একই সময়ে ঢাকায় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করছে।
তাপমাত্রা বাড়লেও সশরীরে ক্লাস করতে চান শিক্ষার্থীরা
দেশব্যাপী গত কয়েকদিন হিট অ্যালার্ট (তীব্র তাপপ্রবাহ) জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। হিট অ্যালার্টের মধ্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ করলেও এখন শর্ত সাপেক্ষে খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র তাপপ্রবাহে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি, চলছে সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম। উল্টো শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনা না করার কথা বলছেন। কেননা এতে শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
এ বিষয়ে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম নিলয় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসে তুলনামূলক তাপমাত্রা কম। এমনকি বাড়ির চেয়ে এখানে তাপমাত্রা বেশ কম। ক্যাম্পাস থেকে বের হলেই আমরা তাপমাত্রার তারতম্য বুঝতে পারি।
তিনি আরও বলেন, দেশে চলমান তাপপ্রবাহর পরও জাহাঙ্গীরনগরে আমরা কিছুটা স্বস্তিতে আছি তাই, আমাদের কোনোভাবেই অনলাইনে ক্লাস করার দরকার নেই। অনলাইনে ক্লাস চালু হলে আমাদের ল্যাব, ক্লাস কিংবা ব্যবহারিক ক্লাসে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এ ছাড়া অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
পরিকল্পিত উপায়ে আরও বনায়নের দাবি
এদিকে শুধু বেশি গাছ থাকাতে স্বস্তি আছে বলে মনে করছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, বনায়ন হতে হবে পরিকল্পিত উপায়ে। অন্যথা বারবার গাছ কেটে ফেলার মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।
ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ একাংশের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, ঢাকার চেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু গাছপালা এবং জলাশয় থাকার কারণে যে তাপমাত্রা কম এটাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থোড়াই কেয়ার করছেন। আমরা চাই, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে বনায়ন এবং উন্নয়ন হোক। সেই সঙ্গে লেকগুলোরও সংস্কার হোক। এতে করে জাহাঙ্গীনগরে প্রকৃতির যে ভারসাম্য তা টিকে থাকবে। নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবাদী ব্যক্তিবর্গ, উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পুরো মাস্টারপ্ল্যানটি হোক পাশাপাশি সকল স্টেকহোল্ডারদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে সেই পরিকল্পনা করা হোক।
তিনি আরও বলেন, কোন জোনে বন থাকবে, কোন জোনে অ্যাকাডেমিক ভবন থাকবে, জলাশয়গুলোকে আরও খনন করে কীভাবে সচল রাখা যায় সেই প্ল্যানগুলো দরকার। আমরা চাই, বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের মতামত নিয়ে সামনের দিনে কাজ হোক। বনায়ন ও জলাশয়গুলোই জাহাঙ্গীরনগরকে তীব্র গরমে বাঁচতে সাহায্য করছে। গত কয়েক বছরে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে ক্যাম্পাসে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে সেগুলোও পুষিয়ে নেওয়া হোক।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, উন্নয়ন করতে হলে তার একটি প্ল্যান থাকা দরকার। যেহেতু এটি একটি প্রতিষ্ঠান এখানে লোক সমাগম থাকবে, ভবন থাকবে। তবে সেটি বাস্তুতন্ত্র ঠিক রেখে করতে হবে। গাছপালা, লেক যদি না থাকে তবে সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকবে না। এটা ঠিক রাখতে হলে পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের এমন গাছ রাখা উচিত যা আমাদের ফুল ও ফল দেবে একইসঙ্গে সৌন্দর্য বর্ধন করবে। এর বাইরে পরিবেশের জন্য উপকারী কিছু গাছ রোপণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, গাছ লাগানোর সময় যেমন সুচিন্তিত উপায়ে গাছ লাগাতে হবে। আবার কাটার সময়েও সুচিন্তিত উপায়ে গাছ কাটতে হবে। কম উপকারী গাছ আবার একদিনেই কেটে ফেললে হবে না। বরং ধীরে ধীরে পরিকল্পনা নিয়ে উপকারী গাছ লাগাতে হবে আবার কম উপকারী গাছ কেটে ফেলতে হবে।
উন্নয়নের নামে গাছ কাটার তোড়জোড়, শঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা
সারাদেশে চলমান তাপপ্রবাহে যেখানে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ঠিক তখনই শংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় দুই ডজন স্থাপনা। এর ফলে কাটা পড়ছে হাজারো গাছ। ভরাট করা হচ্ছে একাধিক জলাশয়। এর পাশাপাশি একাধিক জলাশয়ের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ধ্বংস হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র। যা মারাত্মক শঙ্কার বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রাকৃতিক গঠনের কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকার কথা। তবে রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশির ভাগ সময় ৩ ডিগ্রি কম থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্ধেক এলাকাজুড়ে থাকা ২৭ হাজার গাছ ও প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকায় থাকা জলাভূমি এ তাপমাত্রা কম রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
গবেষণা দলের প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গাছপালার আচ্ছাদন থাকার ফলে সূর্যরশ্মি সরাসরি মাটিতে পৌঁছাতে পারে না। এটি সে এলাকায় মাইক্রো ক্লাইমেট ভালো রাখে। গাছপালা থাকলে মাটিতে অনেক লতা-গুল্ম জন্মে। সব মিলিয়ে স্থানীয় তাপমাত্রা কমে যায়। যে স্থানে গাছ নেই, সেখানে সূর্যের তাপমাত্রা মাটিতে এসে সরাসরি পড়তে থাকে। এতে ক্যাপিলারি ফ্লোর কারণে মাটিতে ভূগর্ভস্থিত পানির স্তর নেমে যেতে থাকে। গাছ কম থাকলে টানা বেশি তাপমাত্রা পরিবেশে যুক্ত হতে থাকে। ৫-৭ দিনের এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির চক্র চলতে থাকলে স্থানীয় পর্যায়ে ধূলিঝড়, নিম্নচাপ ও টর্নেডোর মতো দুর্যোগের সৃষ্টি হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট এলাকাভেদে শিলাবৃষ্টি ও টর্নেডোর মতো ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি।
গবেষণা দলের অন্যতম প্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গাছ রোপণের ক্ষেত্রেও প্রজাতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এমন প্রজাতির গাছ লাগাতে হবে, যার নিচে ঘাস ও লতাগুল্ম জন্মে। যেমন আকাশমণি, মেহগনি, রাবার, বেনজিন প্রজাতির গাছ এ দেশের মাটি, পানি ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ধরনের গাছ তাপমাত্রা কমানো বা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা কম রাখে। যদি দেশি প্রজাতির ও ফলের গাছ লাগানো হয়, তবে তা খাদ্যের জোগান ও তাপমাত্রা কমানো—দুই ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখতে পারবে।
এএএ