গণহত্যার বিচার-সংস্কারের পরেই নির্বাচন চায় শিবির, ৯ দফা আহ্বান

জুলাই-আগস্টে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের চালানো গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোর সংস্কার, আইনের শাসন জারি, সক্রিয় সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পরেই নির্বাচন দাবি করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। তাছাড়া, নিজেদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শিক্ষা কমিশন গঠন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রদানসহ ৯ দফা দাবি আহ্বান করেছে শিবির।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে সংগঠনটির ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানায় সংগঠনটির নেতারা।
“মেধা ও সততায় গড়ব সবার বাংলাদেশ” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শিবিরের ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ থেকে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সংগঠনটি। এর মধ্যে শাখা পর্যায়ে বর্ণাঢ্য র্যালি আয়োজন ; অদম্য মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান; সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও এতিম ছাত্রদের নিয়ে প্রীতিভোজ; ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান; সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান/কালচারাল ফেস্ট আয়োজন; কুইজ, বিতর্ক, প্রতিযোগিতার আয়োজন উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে ৯ দফা আহ্বান করেছে শিবির। এগুলো হলো-
১. স্বাধীন শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া।
৩. জুলাই গণহত্যা, ২৮ অক্টোবর, পিলখানা ও শাপলা চত্বরসহ সকল হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিচারকার্য দ্রুত শেষ করা।
৪. গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং আহতের যথাযথ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা।
৫. দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা এবং সকল ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া।
৬. ফ্যাসিবাদের দোসরদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা।
৭. দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে আইনের শাসন নিশ্চিত করা।
৮. বিগত ১৫ বছরে দায়েরকৃত সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া।
৯. ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আধিপত্যবাদী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র তাদের পুতুল সরকার হাসিনার পতনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি ও দেশীয় দোসরদের মাধ্যমে নানা চক্রান্ত করে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের দেশের সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা বিরামহীন ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। জুলাই গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কার ব্যতীত দেশে কোনো নির্বাচন আয়োজন করলে পুনরায় আধিপত্যবাদীদের দৌরাত্ম্য প্রতিষ্ঠা হবে।
গণহত্যাকারী ও আওয়ামীলীগের বিচার না হওয়া প্রসঙ্গে শিবির সভাপতি বলেন, জুলাইয়ের অভ্যুত্থান-পরবর্তী ৬ মাস অতিক্রান্ত হলেও, সেই গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিচার সম্পন্ন হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম যে, শহীদের রক্তের উপর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জুলাই গণহত্যার বিচার সম্পন্ন করবেন। বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাশাপাশি আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পরিবর্তে জামিনে মুক্ত করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা এখনও আমাদের ভাইদের হত্যার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে হামলা করছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনও স্বৈরাচারের দোসররা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের কাজ করছে। সরকারের নির্লিপ্ততার কারণে পতিত স্বৈরাচার আবার মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর পর এখন প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করার মতো ধৃষ্টতাও দেখাচ্ছে- যোগ করেন তিনি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্বলতা উল্লেখ করে শিবির সভাপতি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যথাযথভাবে শহীদ পরিবারের দায়িত্বগ্রহণ ও আহতের সুচিকিৎসা এবং পঙ্গুত্ববরণকারীদের পুনর্বাসন করতে না পারা আমাদের ব্যথিত করেছে। শুধু সরকার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় মানুষ অভ্যুত্থানে অংশ নেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার ছিল জনজীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখলদারিত্ব আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন জাহিদুল।
তিনি বলেন, পতিত সরকারের শাসনামলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। আওয়ামী সরকার পরিকল্পিতভাবে আগামী প্রজন্মকে বিপথগামী করতে শিক্ষাক্রম থেকে ইসলামী আদর্শ মুছে ফেলে নাস্তিক্যবাদ ও কুফরি চিন্তার প্রচার, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া, মুসলিম ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করে ইতিহাস বিকৃতি ও অবাধ যৌনতার প্রচারণা, অশ্লীলতার মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে শিবির সভাপতি বলেন, বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে বিগত সাড়ে তিন দশকের অধিক সময় ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। অথচ শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা ও শিক্ষার্থীদেরকে আগামীদিনের দেশ পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এখন পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত কোনো ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। কিন্তু সেখানেও একটি ছাত্রসংগঠন শিক্ষার্থীদের দাবির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও লাশের রাজনীতি শুরু করার হুমকি দিচ্ছেন। অবিলম্বে সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের অবাধ গণতন্ত্র ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ করে দাবি জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
কেএইচ/এমএসএ