সম্মাননা-অনুদান-বৃত্তি: জালিয়াতি করে সবই পেয়েছেন ঢাবি শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) এক নারী শিক্ষার্থী ও তার বন্ধুর বিরুদ্ধে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভাবী শিক্ষার্থীদের তথ্য ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন সংগঠন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ তহবিল থেকেও টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা। এমনকি জুলাই বিপ্লবে সক্রিয় না হয়েও জুলাই যোদ্ধা সেজে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের হাত থেকে সম্মাননাও নিয়েছেন ওই নারী শিক্ষার্থী। শুধু তাই নয় রংপুরের এক নারীকে ‘জুলাই আহত’ বানিয়ে টাকা উত্তোলন এবং আর্থিক সমস্যার কথা বলে ঢাবি প্রক্টরের মেয়েকেও প্রাইভেট পড়াচ্ছেন অভিযুক্ত এই নারী শিক্ষার্থী। তারা দুজন মিলে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতারণার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তাদের প্রক্টর অফিসে হাজির করা হলে সেখানে তারা অপরাধ স্বীকারও করেছেন। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে ইতিমধ্যেই ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রক্টর অফিস। জব্দ করা হয়েছে তাদের মোবাইল ফোন।
অভিযুক্ত এই শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের কবি সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। আর তার বন্ধু রাকিবুজ্জামান শুভ। তিনি দর্শন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের কবি জসিমউদ্দীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জান্নাতুল দুই জন শিক্ষার্থীরা নামে মূলত প্রতারণা করেছেন। এরমধ্যে একজন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জুলফা খাতুন ও অন্যজন উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আয়েশা।
জুলফা খাতুনের আইডি কার্ড, সার্টিফিকেট ও মার্কশিট ব্যবহার করে শ্রাবণী ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ’, বসুন্ধরা শুভসংঘ, পে ইট ফরোয়ার্ড, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ তহবিল থেকেও আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন। আয়েশার ভর্তির কথা বলেও বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক অর্থ নিয়েছেন জান্নাতুল।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে ‘জুলফা আক্তার’ নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় নিজের ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ার ছবি দিয়ে ও অন্যান্য কাগজপত্র ব্যবহার করে ১৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন শ্রাবণী। পরে ঢাবির ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের একজন শিক্ষকও তাকে ৫ হাজার টাকা দেন। ওই বছরের জুনে আবারও বন্যায় নিজের বাড়ি ( জুলফার নামে) ডুবে গেছে উল্লেখ করে আরও ১৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন তিনি।
ঢাবি উপাচার্যের ছাত্রকল্যাণ তহবিল সূত্রে জানা যায়, গত বছরের অক্টোবরে শ্রাবণী অর্থনৈতিক সংকটের কারণ দেখিয়ে জুলফার নামে আর্থিক সহায়তা চাইলে তাকে ৪০ হাজার টাকা প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ দপ্তর। আর গত মার্চে নিজের নামে ৩০ হাজার টাকা নেন তিনি। এ সংক্রান্ত আবেদন ও টাকা প্রদানের চেকের সত্যতা পাওয়া গেছে।
পরে, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রংপুরের একজন মেসের রাঁধুনী এক নারী আহত হয়েছেন এবং তাকে সাহায্য করতে হবে মর্মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদে পোস্ট দেন শ্রাবণী। সেখানেও বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে ১৮০০০ টাকা নেন তিনি। এ ছাড়াও অন্য এক নারীকে ফোন কিনে দেওয়া ও আরেকজনকে ছাগল কিনে দেওয়ার কথা বলেও টাকা তুলেছেন তিনি।
তাছাড়া সম্প্রতি শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে এককালীন বৃত্তি বাবদ ৪০ হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি জুলফার নাম ব্যবহার করে। এই বিষয়ে ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটেও তথ্য রয়েছে। আর্থিক দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে ‘পে ইট ফরোয়ার্ড’ নামের একটি সংগঠন থেকে মাসিক ৩ হাজার টাকা বৃত্তি পেতেন শ্রাবণী। এই সুযোগে তিনি উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আয়েশার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা বলে ১৫ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। একই কারণ দেখিয়ে তিনি ছাত্রলীগের সাবেক ঢাবি সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা নেন। এ বিষয়টি পে ইট ফরোয়ার্ড কর্তৃপক্ষ টের পেলে সেবার তিনি ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।
এভাবেই তিনি প্রতারণা চালিয়ে গেছেন। ধরা পড়ার পর প্রক্টর অফিসে বলেছেন নিজের ও পরিবারের আর্থিক অনটনের কথা।
এদিকে শ্রাবণীর বন্ধু রাকিবুজ্জামান শুভর বিরুদ্ধেও চিকিৎসার কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ দপ্তর থেকে টাকা নেওয়া, ধার নিয়ে টাকা ফেরত না দেওয়া এবং শ্রাবণীকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে টাকা আত্মসাতে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদের অ্যাডমিন এবং অভিযুক্তদের শনাক্তকারী শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযুক্ত শ্রাবণী ‘জুলফা’ সেজে তার নাম ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক আইডি খুলে অস্বচ্ছল পরিবারের কথা বলে নিজেকে বন্যার্ত হিসেবে দাবি করেন। বন্যার পানিতে বাড়ি ডুবে যাওয়ার ছবি দেখিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ গ্রুপে নিজের বিকাশ নম্বর যুক্ত করে এনোনিমাস পোস্ট করে বহু টাকা উত্তোলন করে ও জুলফার নাম-তথ্য ব্যবহার করে বৃত্তির মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩ হাজার করে টাকা নিতে থাকে। এভাবে শ্রাবণী দীর্ঘ ১৩ মাস ধরে জুলফা পরিচয়ে কয়েক দফায় এ কাজ করে।
তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে আসল জুলফা টিউশনির জন্য আমার সাথে যোগাযোগ করলে শ্রাবণীর আসল পরিচয় প্রকাশ পায়। পরে জানতে পারি রাকিবুজ্জামান তার সহযোগী ছিল এবং সে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দেয়নি৷
প্রক্টর অফিসে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জুলফা বলেন, ‘আমার নামে ফেক আইডি খুলে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা নিয়েছে। আমার ছবি, পরিচয় ব্যবহার করে আমাকে ছোট করেছে। আমি এর বিচার চাই।’
আরও পড়ুন
অভিযুক্ত জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণী প্রক্টর অফিসে বলেছেন, তিনি অভাবের তাড়নায় এমন করেছেন। তিনি বলেন, যার বাবা নাই, সেই জানে অভাব কী জিনিস। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রাবণীর বন্ধু রাকিবুজ্জামান শুভ বলেন, ওই মেয়ের সাথে আমার আগে সম্পর্ক ছিলো, এখন নেই। এখন সম্পর্ক থাকলেই যে তার সব অপরাধে আমি জড়িত হবো এমন তো না৷ আমি তার সাথে মিলে কোনো প্রতারণা করিনি। আমি তার অপকর্ম সম্পর্কে জানতামও না।
ঢাবির সহকারী প্রক্টর শারমিন কবির মো. দেলোয়ার হোসেন তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কোনো তথ্য দিতে ও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সার্বিক বিষয়ে ঢাবির প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা একটা কমিটি করে দিয়েছি। কমিটি কাজ করছে। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
কেএইচ/এনএফ