‘নৌকার কর্মীদের’ ববির বিভিন্ন পদে বসাচ্ছেন উপাচার্য

২০২৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে অংশ নেন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ। তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। ওই নির্বাচনের উপদেষ্টা কমিটির ১২ নম্বর সদস্য ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো আব্দুল কাইয়ুম। এর আগে আব্দুল কাইয়ুম ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর রাজনৈতিক কর্মী। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কালীবাড়ি রোডস্থ সেরনিয়াবাত ভবনে তাকে পাওয়া যেত।
চব্বিশের গণআন্দোলনে প্রক্টরের দায়িত্বে থাকা কাইয়ুম আন্দোলনকারী এবং আন্দোলন সমর্থনকারী শিক্ষকদের কঠোর হস্তে দমনের ঘোষণা দেন। সরকার পতন হলে প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেও আট মাসের ব্যবধানে ড. কাইয়ুমকে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কমিটির অর্থ বণ্টন কমিটির আহ্বায়ক করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। বিধি লঙ্ঘন করে আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী সহযোগী অধ্যাপক ড. ইসরাত জাহান লিজাকে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিনের দায়িত্ব দিয়েছেন। একই সাথে রেখেছেন আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার নামে এভাবেই একের পর এক সমালোচিত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন উপাচার্য। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা শিক্ষক-কর্মচারীদের সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ইউজিসির বিধি লঙ্ঘন, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, বিতর্কিত নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এসবের প্রতিবাদ করায় অনেকেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ারও হুমকি দিচ্ছেন উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্ট্যাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল বৈষম্যবিরোধী। আর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্যের মধ্যেই পরিচালিত হয়। হাসিনার অপশাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা ছিল তারা আজকেও কোনঠাসা। আর যারা হাসিনার সরকারের গণহত্যার পক্ষে গলা উঁচু করে সাফাই গেয়েছে তারাই এখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্যের অতীত যদি আমরা দেখি তিনিও চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের বিরোধী। উপাচার্যের কর্মকাণ্ডে তাকেও অপশক্তির পক্ষের লোক বলে আমাদের কাছে মনে হয়।
বাংলা বিভাগর সহযোগী অধ্যাপক সঞ্জয় সরকার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সকলের জন্য বিব্রতকর। যে প্রত্যাশা নিয়ে চব্বিশের অভ্যুত্থান হয়েছে এখানে তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। কেবল তাই নয়, উপরন্তু আন্দোলনের বিরোধিতাকারী ও পতিত সরকারের আমলের সুবিধাভোগীদেরই পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নকে প্রাধান্য না দিয়ে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। অথচ আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষক ও শিক্ষাথীবান্ধব বৈষম্যহীন প্রশাসন।
বিভিন্ন পদে পতিত সরকারের সহযোগীরা
যৌন কেলেঙ্কারীর দায়ে ২০১৯ সালে রেজিস্ট্রার পদ থেকে বরখাস্ত হন মনিরুল ইসলাম। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০২৩ সালে স্বপদে বহাল হন তিনি। বহালের পরপরই শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর হয়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তা শুরু করেন। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক দফা ঘোষণার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠকে মনিরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে দ্বার্থহীন কণ্ঠে স্পষ্টভাবে বলতে চাই আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথেই আছি। শিক্ষার্থীদের ঘোষিত দাবির সাথে নেই, জননেত্রী শেখ হাসিনাতে আস্থা রাখি এবং আস্থা রাখবো।
মনিরুল ইসলাম চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি উপাচার্যের পাঠানো অফিস আদেশে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়। যা ইউজিসির নির্দেশনার স্পষ্ট লঙ্ঘন। এর আগে আওয়ামী লীগের অনুসারী জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখেন উপাচার্য। এ নিয়ে আন্দোলনের মুখে কলিমুল্লাহকে কমিটি থেকে বাদ দেন।
আরও পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের প্রধান সুব্রত কুমার বাহাদুরকে সরিয়ে পটুয়াখালীর সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুন্নেছা ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সুলতান আহমেদ মৃধার ছেলে মাসুম আতিকুর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর নৌকা প্রতীকের নির্বাচনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল বাতেন চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির (ক্লাস্টর-১) আহ্বায়কের দায়িত্ব। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির (ক্লাস্টর-২) আহ্বায়ক করা হয়েছে সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল কাইয়ুমকে। বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক সুমন সেরনিয়াবাতের চাচা শ্বশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে করা হয়েছে উপাচার্যের একান্ত সচিব।
শেখ হেলালের সুপারিশে চাকরিপ্রাপ্ত বলে প্রচার করা সহকারী স্টোর অফিসার জাহাঙ্গীর আলম রাহাতকে সংযুক্ত করা হয়েছে উপাচার্যের দপ্তরে। বাউফল উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোশারেফ হোসেন খানের জামাতা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হাফিজুর রহমানকে যুক্ত করা হয়েছে উপাচার্যের দপ্তরে। শুধু তাই নয়, বিগত কয়েকদিনে গঠিত পাঁচটি কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানভীর কায়সারকে বিধি ভেঙে ভর্তি পরীক্ষার ‘গ’ ইউনিট সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ডেপুটি-রেজিস্ট্রার বাহাউদ্দিন গোলাপকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির উপলাইব্রেরিয়ান করা হয়েছে। যদিও এই পদে যাওয়ার জন্য যে উচ্চতর ডিগ্রি দরকার, তা তার নেই। বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্যু ক্লার্ক বনি আমিনকে সংযুক্ত করা হয়েছে রেজিস্ট্রারের দপ্তরে।
উপাচার্য বিরোধীদের হয়রানি
উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করায় অনেককেই দাপ্তরিকভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এর মধ্যে সহকারী রেজিস্ট্রার মনোয়ার হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে, উপ-রেজিস্ট্রার দিদার হোসেন খানকে রেজিস্ট্রার দপ্তরে, উপাচার্যের একান্ত সচিব বোরহান উদ্দিনকে উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে এবং উপাচার্যের পিএ-২ রুহুল আমিনকে টিএসসিতে বদলি করা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গঠিত কমিটি, কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা হয়। মানসিক দিক দিয়ে চাপে রাখা হয় বিভিন্ন অজুহাতে। সর্বশেষ ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিনকে আক্রমণাত্মক ভাষায় অব্যাহতিপত্র পাঠানো হয়েছে।
অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিন বলেন, আমরা যা দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিধি বিধান আছে তা মেনে চলা হয় না। বর্তমানে রেজিস্ট্রার যিনি আছেন আমি মনে করি তিনি বৈধভাবে নেই। একাডেমিক কার্যক্রম প্রো-ভিসির সম্পৃক্ততা ছাড়া হচ্ছে, যা সঠিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যত লাভজনক কমিটি আছে তাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যারা বদ্ধপরিকর ছিল তাদেরকে। আর জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থী নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা যারা ছিলাম তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করছে। জানতে পেরেছি, ট্রেজারারের স্বাক্ষর ছাড়াই অবৈধভাবে নিযুক্ত অনেকের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মামুন অর রশিদ বলেন, উপাচার্য মহোদয় বিভিন্ন উপায়ে ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন করছেন। ছাত্র আন্দোলনের সময় তৎকালীন প্রক্টর ড. আব্দুল কাইয়ুমের হুকুমে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হল। অথচ সেই কাইয়ুমকে নানা দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর যারা ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিল তাদের সহ্য করতে পারছেন না উপাচার্য মহোদয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানি বলেন, আমাদের সরকার নিযুক্ত করেছে। উচিত ছিল আমরা সকলে মিলেমিশে বিশ্ববিদ্যালয়টি এগিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু উপাচার্য মহোদয় আমাকে উপেক্ষা করেন। এমনকি তিনি একক সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা করছেন।
যা বলছেন উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন
আওয়ামী লীগের অনুসারীদের পুরস্কৃত করার বিষয়ে ড. শুচিতা শরমিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো নিয়োগ পতিত আওয়ামী সরকারের সময়কার। অতীতে কীভাবে নিয়োগগুলো হতো তা সবাই জানে। যদি আমরা কাজ করতে চাই তাহলে চেষ্টা করবো শিক্ষকদের মর্যাদার জায়গাটি বজায় রেখে তারা যেন সবাই কাজ করতে পারেন। এখানে কাউকেই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। অতীতের কমিটি দেখেইতো বের করতে হয় কীভাবে কাজ করতে হবে। খুব বেশি বড় কিছু পরিবর্তন করতে পারিনি। বিগত ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে সকলকে নিয়ে কমিটি হয়েছে, এবারও একইভাবে সকলকে নিয়ে কমিটি হয়েছে। কথায় বলে, ‘ঠগ বাছতে গিয়ে গা উজার হয়ে যায়।’ তেমনি এখানে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) যদি আমি বাছাই করতে যাই তাহলে গা উজার হয়ে যাবে। আমার বিষয়টি এ রকম যে, কাজটাকে আমার সফলভাবে করতে হবে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একই রকমের চিত্র। কারণ বিগত ১৫ বছরে যে রিক্রুটমেন্টগুলো হয়েছে সেগুলোতে এই সমস্যা রয়েই গেছে।
উপাচার্য বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি দেখছি কিছু মানুষ অতি উৎসাহী হয়ে বেশি খবর প্রচার করার চেষ্টা করছে। আমি বরিশালের মানুষ নই, তবে যা জানতে পেরেছি শুধু তিনি (আব্দুল কাইয়ুম) নন এমন অন্তত ২০ জন শিক্ষক সরাসরি মিছিল মিটিং করেছেন। যদি এমন হয় সরকার থেকে নির্দেশনা আসে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আমি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
আরএআর