নিয়োগের শর্ত পূরণ না করেও উপাচার্যের মৌখিক অনুমোদনে শিক্ষক তিনি

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের সভাপতি বিপুল রায়কে আওয়ামী লীগের শাসনামলে জিওগ্রাফি ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চাকরি বাঁচাতে বিভাগের নাম পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে প্রভাবিত করারও অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের শর্ত পূরণ না করলেও তৎকালীন আওয়ামীপন্থি উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন উর-রশিদ-আসকারী তাকে নিয়োগ দেন বলে জানা গেছে।
তবে ওই শিক্ষক নিয়মতান্ত্রিকভাবেই নিয়োগ পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি ও নিয়োগ বোর্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড জিওগ্রাফি, জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ ও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থীদের থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের ধারা ৪০ (১) এর চাকরির শর্তাবলীতে বলা হয়েছে, ‘নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যে যে শর্ত নির্ধারণ করিবেন, সে সে শর্ত অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক অফিসার অথবা বেতনভোগী শিক্ষক এবং কর্মচারী নিযুক্ত হইবেন।’ তবে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ না থাকলেও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ থেকে পড়াশোনা করা বিপুল রায় আবেদন করেন এবং তৎকালীন প্রশাসন তাকে নিয়োগ দেয়। অনুসন্ধানে এ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন প্রশাসনের সঙ্গে জোর লবিং থাকায় বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগের স্পষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা লঙ্ঘন করে বিপুল রায়কে নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে বিভাগের সঙ্গে তার অধ্যয়ন করা বিষয়ের মিল রাখতেই তিনি নাম পরিবর্তন করতে শিক্ষার্থীদের দিয়ে আন্দোলনের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন। এছাড়া একটি সূত্রের দাবি, তার অধ্যয়ন করা বিভাগের ঘনিষ্ঠদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য তিনি নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন।
বিভাগটির নাম পরিবর্তন নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্ত দেখা দেয়। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে বিভাগের নামফলক ভাঙচুরসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিভাগটির বর্তমান সভাপতি নতুন নামকরণের পক্ষে বলে জানা গেছে। বিভাগটির সিনিয়র দুই ব্যাচসহ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বর্তমান নামের পক্ষে এবং অন্য একটি পক্ষ ‘জিওগ্রাফি’ বাদ দিয়ে ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ নামকরণের দাবি করছেন। বর্তমান সভাপতি নতুন নামকরণের পক্ষে এবং অন্য তিনজন বর্তমান নামের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ২০১৭ সালে বিভাগটি চালুর পর নাম পরিবর্তন হওয়ার দুই বছর পর আবারও নাম পরিবর্তনের বিষয়টি ক্যাম্পাসে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে পরবর্তী তিন ব্যাচের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের একাংশ দ্বিতীয় দফায় বিভাগের নাম পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। বিভাগের বর্তমান সভাপতি বিপুল রায় নাম পরিবর্তনের আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছেন। তিনি শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত বিভাগে না পড়েও নিয়োগ পান। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে রদবদল হওয়ায় চাকরি হারানোর ভয়ে বিভাগের নাম পরিবর্তনে জোর দিচ্ছেন তিনি।
বিপুল রায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
দ্বিতীয় দফায় বিভাগের নাম পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রথমবার নাম পরিবর্তনের সময় তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেছিলেন সিনিয়র দুই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। তারা কোনো শিক্ষকের ইন্ধন ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজেদের প্রয়োজনে বিভাগের নাম পরিবর্তনের আন্দোলন করছেন।
অন্যদিকে বিভাগের নাম অপরিবর্তিত রাখার পক্ষে থাকা সিনিয়র শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রথমবার নাম পরিবর্তনের সময় সবাই স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে স্বাক্ষর দিয়েছিল। পরিবর্তনের পর উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছিল। দুই বছর পর এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শিক্ষক বিপুল রায়ের ইন্ধনে তারা স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার প্রশাসন ভবন তালা দিয়ে আন্দোলন করেন। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিন্ডিকেট সভায় সমাধানের আশ্বাস দিলে স্থগিত করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, শিক্ষক বিপুল রায় তার সনদের সঙ্গে বিভাগের নামের মিল করতেই নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন। একমাত্র যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামে বিভাগ নেই। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগসহ ইতিবাচক বিভিন্ন বিষয় সামনে রেখে বিভাগের নাম জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট করা হয়েছিল। কিছুদিন পর পর নাম পরিবর্তন অযৌক্তিক।
বিভাগটির সাবেক সভাপতি ইনজামুল হক বলেন, আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে। যেটি শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারের জন্য ভালো হবে তেমনই সিদ্ধান্ত আসুক এটাই প্রত্যাশা।
এ বিষয়ে কথা বলতে বিভাগের সভাপতি বিপুল রায়কে গত কয়েকদিন একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। বিভাগে গিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তবে এর আগে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমি শুধু প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেছিলাম। শর্ত পূরণ করে কি-না সে বিষয় প্রশাসন দেখবে। এছাড়া সবকিছু যাচাই-বাছাই করে আমার নিয়োগ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নাম পরিবর্তনের আন্দোলনে আমার সম্পৃক্ততা নেই। শিক্ষার্থীরা কেন আবারও নাম পরিবর্তন চায় তা আমি জানিনা।
এদিকে বিভাগটির নিয়োগের প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি গণিত বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগটির তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বিপুল রায়ের বিভাগের নাম মিল ছিল না। আমি তৎকালীন উপাচার্যের (ড. হারুন উর-রশিদ আসকারী) থেকে মৌখিকভাবে অনুমোদন নিয়েছিলাম। শিক্ষক বিপুল রায়ের বিভাগের নাম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ না থাকলেও তাকে যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয়ছিল। সে সময় এটি নিয়ে কেউ আপত্তি করেনি। বিভাগের শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের কারণে এগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-উর-রশিদ আসকারী বলেন, মৌখিক অনুমোদনের কোনো গুরুত্ব নেই। কোনো প্রার্থী শর্ত পূরণ করেছে কিনা সেই বিষয়গুলো প্ল্যানিং কমিটি দেখে। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে সেটি প্ল্যানিং কমিটিকে বলতে হবে। এছাড়া নিয়োগ বোর্ডে বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞরা ছিলেন, যাচাই-বাছাই করে প্রার্থী নিয়েছেন।
বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, বিগত সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল দুর্নীতি এবং শিক্ষক নিয়োগ খতিয়ে দেখতে আমি ইউজিসিকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি করার আবেদন করেছিলাম। তবে আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি করে প্রতিবেদনের আলোকে প্রয়োজন হলে পুনরায় অবগত করার কথা জানিয়েছিল ইউজিসি। কাজ করছে কমিটি। আর নাম পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
রাকিব হোসেন/আরএআর