টিউশনিতে চলতো পড়াশোনার খরচ, হয়েছেন পররাষ্ট্র ক্যাডার

বাবার ব্রেইন স্ট্রোক-পরবর্তী দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঘটনায় ভেঙে পড়ার বদলে নিজেই দায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে। পড়ার পাশাপাশি শুরু করেন টিউশনি। প্রতিদিনের ক্লাস, টিউশনি, পড়াশোনা—সবকিছু মিলিয়ে তার দিনগুলো ছিল এক নিঃশ্বাসে ছুটে চলার মতো। কিন্তু হার মানেননি। স্বপ্ন ছিল বিসিএস, আর সে লক্ষ্যেই এগিয়ে গেছেন ধাপে ধাপে। আজ তার নামের পাশে যুক্ত হয়েছে গৌরবের এক নতুন পরিচয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা।
বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের সাবেক শিক্ষার্থী সোহেল রানার কথা। নওগাঁর মহাদেবপুরের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া ছেলেটি কখনও ভাবেননি, একদিন তিনি দেশের পররাষ্ট্র ক্যাডারে জায়গা করে নেবেন। কেননা জীবন তার সামনে সাজিয়ে রেখেছিল একের পর এক চ্যালেঞ্জ।
মহাদেবপুরে বেড়ে ওঠা সোহেল তার বাবা-মা এবং দুই বোনসহ পাঁচজনের পরিবারে সবার ছোট। মহাদেবপুরের জাহাঙ্গীরপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
৪৩তম বিসিএসে সোহেল শিক্ষা ক্যাডার পেয়ে নওগাঁর সাপাহার সরকারি কলেজে যোগদান করেন। আর গত ৩০ জুন প্রকাশিত ৪৪তম বিসিএসের ফলাফলে তিনি পররাষ্ট্র ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন, যা তার দীর্ঘদিনের সংগ্রামের এক সার্থক পরিণতি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনার প্রতি ততটা মনোযোগী না হলেও, স্নাতক শেষে তার বন্ধুরা তাকে চাকরির প্রস্তুতির পরামর্শ দেন। ২০২১ সালে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর তিনি রাজশাহীতে ফিরে পুরোদমে বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করেন। প্রস্তুতির সময়ও তাকে টিউশন করাতে হয়েছে, যা তার প্রস্তুতির জন্য দৈনিক ৪-৫ ঘণ্টা কেড়ে নিত। অনেকবারই তার মনে হয়েছে, তার পক্ষে বিসিএস পাশ করা সম্ভব নয়। প্রিলি বা অন্যান্য পরীক্ষায় ভালো ফল না এলে হতাশায় ভেঙে পড়েছেন তিনি। বন্ধু-বান্ধবরা যখন চাকরি পাচ্ছিল বা বিদেশ যাচ্ছিল, তখন তার নিজের কিছু না হওয়াটা তাকে কষ্ট দিত।
আরও পড়ুন
সোহেলের অনুপ্রেরণা ছিল মূলত অন্যদের সাফল্য। তিনি বলেন, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখতাম অনেকে প্রথম হচ্ছেন, অনেক সিনিয়ররা চাকরি পাচ্ছেন। এগুলো দেখে নিজেকে মোটিভেট করতাম, ওরা পারলে আমি কেন পারব না। এটা ভেবেই পড়াশোনা করেছি, রিজিকে থাকলে পারব, ইনশাআল্লাহ। প্রিলি বা রিটেনের আগে তিনি দিনে ১০-১২ ঘণ্টা পড়াশোনা করতাম।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে উল্লেখ করে সোহেল বলেন, বাবা তো অন্ধ, পরিবারের অবস্থাও ভালো ছিল না। টিউশনি করিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি। এমনকি দিনে ৫টা টিউশনিও করেছি। রাজশাহীতে টিউশনি পাওয়া যায় না সহজে, টাকার পরিমাণও কম। তারপরও অনেক খুঁজে ম্যানেজ করেছি। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনির চাপ সামলানো ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল স্নাতক শেষ করার পরের তিন-চার বছর, যখন বেকার ছিলাম। এই সময়ে সমাজের নানা কটু কথা মানসিক যন্ত্রণা দিতো। সোহেল বলেন, অনেকে অনেক কথা বলেছে। আত্মীয়-স্বজনরা বলতেন, “কি ব্যাপার? পড়াশোনা শেষ, চাকরি কবে করবা?” তখন কিছু বলতে পারিনি। বলতাম চেষ্টা করছি, দোয়া রাখবেন। পরিবার থেকেও শুনতে হয়েছে, “সবাই চাকরি করে, তুই কী করিস?” এই বেকারত্ব আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। পরীক্ষার জন্য বার বার ঢাকা যাওয়া এবং বই কেনার খরচ জোগাতেও হিমশিম খেতে হয়েছে।
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, অনুভূতি বলে প্রকাশ করা যাবে না। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সবাই অনেক খুশি। বাবা-মা অনেক খুশি। আমার ওয়াইফও অনেক খুশি। সবার থেকে ভালো রেসপন্স পাচ্ছি।
একজন রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে সোহেলের এখন প্রধান উদ্দেশ থাকবে পররাষ্ট্রবিষয়ক কাজগুলো, বিশেষ করে প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের চাকরি নিয়োগ ও যাতায়াত সহজ করা এবং বিদেশে গিয়ে যেন তারা সহজে কাজ পান, তা নিশ্চিত করতে চান।
তার এই সফলতার পেছনে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের অকুন্ঠ সমর্থন ছিল। সোহেল তার বন্ধুদের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করতেন এবং একসঙ্গে পড়াশোনা ও কোচিং করতেন। বাবা-মায়ের দোওয়ার কারণেই তিনি আজ এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন বলে জানান।
যারা আগামীতে বিসিএস দিতে আগ্রহী, তাদের উদ্দেশে সোহেল বলেন, ডেডিকেশন থাকতে হবে, ফোকাস থাকতে হবে। সরকারি চাকরি, বিসিএস বা ব্যাংক জব যদি কেউ করতে চায়, সেই মোতাবেক আগাতে হবে। অবশ্যই কোনো পিছুটান থাকা যাবে না। এখন যে কম্পিটিশন, দিনে অবশ্যই ৮-১০ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হবে।
জুবায়ের জিসান/এএমকে