ঢাবিতে জলনিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘জল নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তন : স্থানীয় জ্ঞান, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার (৬ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের অর্থায়নে এবং সেন্টার ফর কালচার অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স স্টাডিজের সহায়তায় ঢাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগ এ আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী মো. ওয়ালিউল হক, ডব্লিউএসসিসি গবেষণা প্রকল্পের সহকারী পরিচালক ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহিদুল ইসলাম এবং ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. তৈয়বুর রহমান।
সম্মেলনের মূল আলোচক ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের উপদেষ্টা ড. আইনুন নিশাত। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন নেপালের পাঠান একাডেমি অব হেলথ সায়েন্সেসের স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক মধুসূদন সুবেদী এবং ওয়াটার রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট আফ্রিকার ওয়াটার প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট ড. জাবলান আদানে।
স্বাগত বক্তব্য দেন সম্মেলনের আহ্বায়ক ড. তারেক আহমেদ। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন সেন্টার ফর কালচার অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স স্টাডিজের পরিচালক ও ডব্লিউএসসিসি গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক হাসান শাফি।
সম্মেলনে আলোচকরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, অভিযোজনজ্ঞান ও উদ্ভাবন কীভাবে বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট সমাধানে অবদান রাখতে পারে তা তুলে ধরা হয়।
প্রধান অতিথি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশের উপকূলীয় নারীদের জলসংকটের বাস্তবতা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু ন্যায্যতা, প্রযুক্তি সহায়তা ও ন্যূনতম আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পরিবারের পানির যোগান দাতা হিসেবে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। অনেক এলাকায় নারীরা তিন-চার দিন যথেষ্ট পানি পান না, নিরাপদ পানির জন্য দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হয়। মাসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনায় কিশোরীরা মারাত্মক বিপাকে পড়ছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি খেয়ে মাসিক চক্র বিলম্বিত করছে। গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ই–ক্ল্যাম্পসিয়ার মতো জটিলতা বেড়ে সাধারণ অবস্থায় পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন–সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলো দাতা দেশগুলো যথাযথভাবে পালন করছে না। নতুন সহায়তার বদলে অনেক ক্ষেত্রেই ঋণের বোঝা চাপানো হচ্ছে, যা বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ‘দ্বিগুণ শাস্তি’।
বাংলাদেশের পানি নিরাপত্তা প্রসঙ্গে পরিবেশ উপদেষ্টা জানান, দেশটি সব নদীর নিম্নগতিতে থাকা ‘লোয়ার রিপেরিয়ান’ হওয়ায় সীমান্তবর্তী নদীগুলোর পানিবণ্টন পুরোপুরিই আন্তর্জাতিক রাজনীতিনির্ভর। উজানের দেশগুলো বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ঢুকিয়ে বন্যা বাড়িয়ে তোলে এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের ট্রান্স–বাউন্ডারি ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট কনভেনশন ২০২৪ সালে কার্যকর হলেও অনেক উজানের দেশ এখনো এতে যোগ দেয়নি। বাংলাদেশও কনভেনশনটিতে এখনো সম্পৃক্ত নয়, তবে পানি–বণ্টনসংক্রান্ত আরেকটি ইউরোপকেন্দ্রিক ইউএন কনভেনশনে যোগ দিয়েছে–যা ভবিষ্যৎ আলোচনায় নতুন প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।
তিনি বলেন, হিমালয় বা গঙ্গা অববাহিকার পরিবর্তন আন্তঃসীমান্ত দেশগুলোকে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশ ‘ওয়াটারলেস কান্ট্রি’ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কোনো দেশ পানিশূন্য হলে তার জনগণ বাধ্য হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পানি খুঁজবে—যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে। তাই পানি ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক সমন্বয় জরুরি।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও জানান, সরকার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, নদী–খাল পুনরুদ্ধার এবং উপকূলে স্বল্প খরচে ছোট ডেস্যালিনেশন প্ল্যান্ট স্থাপনের মতো উদ্যোগ নিচ্ছে, যেখানে স্থানীয় নারীরাই ব্যবস্থাপনায় যুক্ত থাকবেন।
তিনি সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, অভিযোজনের সীমা আছে। উন্নত দেশগুলো যদি কার্বন নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে আর্থিক সহায়তা যতই আসুক ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো তা দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে না। তিনি বলেন, আজ শুধু পানি নিরাপত্তা নয়, এটি পানি ন্যায্যতার প্রশ্ন। উন্নয়ন প্যারাডাইম, ভোগের ধরন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বদলাতে না পারলে জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই সম্মেলন থেকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে তিনি আশা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সংকটে যেমন এগিয়ে আসে, জলবায়ু সংকটেও তেমন ভূমিকা রাখবে।
মূল আলোচক অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জানান, বৈশ্বিক ক্লাইমেট চেঞ্জে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৪৭ শতাংশ। এ সমস্যার মূল দায় বহন করছে বৃহৎ নিঃসরণকারী দেশগুলো—চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।
এসএআর/এমএন