মুরগিতে লোকসান, কোয়েলে চমক মেহেদীর

কলেজ শিক্ষার্থী শেখ মেহেদী। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ছোটবেলা থেকে পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে নিজেকে যুক্ত করেছেন। করোনাকালীন বাড়িতে বসে না থেকে শুরু করেন দেশি মুরগির ব্যবসা। কিন্তু বাজারে হঠাৎ দরপতনে লোকসানের মুখে পড়েন তিনি। এতে হতাশ হয়ে পড়েন। এ সময় (২০২০ সালের ডিসেম্বর) অনেকটা শখের বসেই শুরু করেন কোয়েল পালন। আর এই কোয়েলেই ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে মেহেদীর। মাত্র ৭৯টি বাচ্চা থেকে শুরু করে মেহেদীর খামারে এখন ১৫ হাজার কোয়েল। খামার থেকে তার মাসিক আয় হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। শুধু মেহেদী নয়, তার এই খামারের ফলে ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে অন্তত ২০টি পরিবারের।
বাগেরহাট সদর উপজেলার কাশেমপুর গ্রামে রাস্তার পাশে মেহেদী হাসানের বাড়ি। মাটির রাস্তা ধরে সকালে বাড়ির উঠানে প্রবেশ করতেই দেখা মিলে কর্মব্যস্ততা। চার-পাঁচজন মানুষ কাজ করছেন। কেউ ডিম এনে গাড়িতে উঠাচ্ছেন, কেউবা কোয়েলের বাচ্চা গুনছেন। কেউ আবার খাবার দিচ্ছেন পাখিগুলোকে।
ডিম এবং মাংসের জন্য আলাদা আলাদা ঘরে কোয়েল পালন করেন মেহেদী। বাবা শেখ সরোয়ার হোসেন, মা নার্গিস বেগম ও স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থী বোন মারিয়া খাতুন সবাই মিলে কোয়েলের যত্ন করেন। প্রতিদিন ৪ হাজার ৫০০ ডিম ও সপ্তাহে প্রায় ৫ হাজার মাংসের কোয়েল বিক্রি করেন তিনি। প্রতিটি ডিম ২ টাকা থেকে ২ টাকা ৫ পয়সা এবং মাংসের কোয়েল ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় পাইকারি দরে। সব খরচ বাদ দিয়ে দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হয় মেহেদীর।

ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন মেহেদী হাসানের বাবা সরোয়ার হোসেন। ছেলে কোয়েল পাখির খামার শুরু করলে চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন বাড়িতে। ছেলের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ শুরু করেন খামারে।
সরোয়ার হোসেন বলেন, আমি পাখির খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে ডিম বাছাইসহ পরিচর্যার কাজ করি। ফজরের নামাজের পর থেকেই খামারে কাজ শুরু করতে হয়। রাত পর্যন্ত অনেক কষ্ট করা লাগে। কিন্তু মনের আনন্দে কাজ করি। পরিবার নিয়ে এক সাথে থাকি। আল্লাহর রহমতে আমরা অনেক ভালো আছি।
ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানো, ডিম এবং মাংসের জন্য বাচ্চা বাছাইয়ের মূল কাজ করেন মেহেদীর বোন সরকারি পিসি কলেজের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থী মারিয়া খাতুন।

মারিয়া বলেন, পড়াশুনার পাশাপাশি ভাইয়ার ফার্মে সহযোগিতা করি। এতে আমার সময় যেমন ভালো কাটে, তেমনি ভাইয়ার সহযোগিতাও হয়। পরিবারের সবাই কাজ করার কারণে আমাদের বাইরে থেকে কাজের লোক নিতে হয় না। আমাদের নিজের হাত খরচের টাকাও এখান থেকেই হয়ে যায়।
মেহেদীর মা নার্গিস বেগম বলেন, রান্না ও ঘর গোছানোর বাইরে আমাদের বাকি সময় কাটে কোয়েলের ফার্মে। প্রতিদিন খাবার পানি দেওয়া, পানির পাত্র পরিষ্কারসহ নানা কাজ রয়েছে। কোয়েলের যত্ন করতে আমাদেরও অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।
খামারে পাখি দেখতে আসা পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা বন্ধুরা প্রায়ই এখানে কোয়েল পাখি দেখতে আসি। মেহেদী ভাই আমাদের পাখির ডিম খেতে দেয়। আমাদের ঘুরে ঘুরে পাখি দেখতে খুব ভালো লাগে।

মেহেদীর খামার থেকে ডিম ও পাখি নিয়ে অটোগাড়িতে করে ফেরি করে বিক্রি করেন সদর উপজেলার ডেমা গ্রামের অটোচালক (ব্যাটারিচালিত যান) ইয়াসিন গাজী। তিনি বলেন, আগে ভাড়ায় গাড়ি চালাতাম। সারা দিন গাড়ি চালিয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হত। পরে মেহেদী ভাইয়ের ফার্ম থেকে ডিম ও পাখি নিয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী জেলাতেও বিক্রি শুরু করি। এখন আমার দিনে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। আমার মতো আরও তিন-চারজন ভাড়ায় চালানোর বদলে ফেরি করে পাখি ও ডিম বিক্রি করে। আমরা আগের চেয়ে ভালো আছি।
মেহেদীর খামার থেকে বাচ্চা নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন বাগেরহাট সদর উপজেলা ফতেপুর গ্রামের মো. সুমন। বর্তমানে সুমনের খামারে রয়েছে প্রায় তিন হাজার কোয়েল। সুমন বলেন, আমাদের বাজারে অটোতে করে কোয়েল পাখি ও ডিম বিক্রি করেন একজন। তার কাছ থেকেই খবর পাই মেহেদী ভাইয়ের। ঘুরতে ঘুরতে এক দিন চলে যাই মেহেদী ভাইয়ের খামারে। খামার থেকে কিছু বাচ্চা বাড়িতে এনে আমিও কোয়েল পালন শুরু করি। এখন আমার খামারে ৩ হাজারের মতো কোয়েল রয়েছে। এই খামার থেকেই আমার জীবনে সচ্ছলতা এসেছে।
তবে শুধু সুমন নয়, ফতেপুরের ইয়াছিন, রাকিব, ফুলতলা এলাকার রবিউল, সোহাগসহ বেশ কয়েকজন যুবক মেহেদীর কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে কোয়েলের খামার শুরু করেছেন।
সরকারি পিসি কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী খামার মালিক শেখ মেহেদী হাসান বলেন, ২০২০ সালের প্রথম দিকে আমি দেশি মুরগি পালন করতাম। কিন্তু রোগে মৃত্যু ও দাম কমে যাওয়ার কারণে আমি প্রায় সাত লাখ টাকার দেনা হয়ে যাই। এরপর একই বছরের ডিসেম্বরে আমি কিছু কোয়েলের ডিম আনি খাওয়ার জন্য। কিন্তু আম্মা বলে এত ডিম খাওয়া যাবে না। তাই কিছু ডিম ইনকিউবেটরে দিই। এ সময় দেখি মুরগির চেয়ে কোয়েলের বেঁচে থাকার হার বেশি। বর্তমানে এই খামার দিয়েই আমি দেনা প্রায় শোধ করেছি। আশা করি কোয়েল চাষের মাধ্যমেই পরিবার নিয়ে ভালো থাকতে পারব এবং বেকার অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারব।
কোয়েল পালন ও ব্যয় সম্পর্কে মেহেদী হাসান বলেন, ডিম থেকে ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ১৬ দিন। একটি বাচ্চা মাংসের উপযোগী হয় ২৭-২৮ দিনে। বাচ্চা থেকে ডিম দেওয়া শুরু করে ৪৫-৫০ দিনের মাথায়। প্রতিটি কোয়েলের পেছনে দিনে ৪৫ থেকে ৫০ পয়সার খাবার ব্যয় হয়। এর সঙ্গে কর্মচারী, বিদ্যুৎ বিলসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন ব্যয় রয়েছে।
বেকার ও তরুণদের উদ্দেশ্যে মেহেদী বলেন, যেকোনো পরিবেশে খুব অল্প সময়ে কম ব্যয়ে কোয়েলের চাষ করা যায়। কোয়েল পালনের সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে এর জন্য কোনো ওষুধ লাগে না। রোগ হওয়ার আগেই কোয়েল বিক্রি করা যায়। সেক্ষেত্রে স্থানীয় বা দূরের কোনো উদ্যোক্তা যদি কোয়েল পালনে আগ্রহী হন সেক্ষেত্রে নতুনদের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন সফল এই উদ্যোক্তা।
মেহেদীর মতো তরুণ উদ্যোক্তাদের কোয়েল চাষে উৎসাহ দিতে এবং নতুন বাজার সৃষ্টিতে প্রাণিসম্পদ বিভাগ কাজ করছে বলে জানান বাগেরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, কোয়েল পাখির মাংস ও ডিম গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের রোগীদের জন্য এই পাখির ডিম খাওয়া বেশি উপকারী। তবে স্থানীয়ভাবে এই পাখির বাজার এখনও তৈরি হয়নি। বর্তমান যারা খামারি রয়েছেন তাদের জন্য বাজারের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তানজীম আহমেদ/এসপি