পাহাড়ে চার জার্মান সৈনিককে আটক করি : বিশ্বযুদ্ধজয়ী নূর মোহাম্মদ

যুদ্ধ চলাকালীন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সৈনিকদের সঙ্গে অনেক উঁচু এক পাহাড়ে অভিযানে যাই। সেখানে তখন প্রচুর বরফ পড়ছিল। আমাদের পায়ে তখন গামবোট ছিল। বরফ আচ্ছাদিত অবস্থায় পা তখন প্রায় ডুবো ডুবো। ঠিক তখনই পাহাড়ে চার জার্মান সৈনিককে পেয়ে ঘেরাও করি। পরে তাদের আটক করে গাড়িতে নিয়ে আসি। তারপর নিয়ে আসি ক্যাম্পে।
ঢাকা পোস্টের কাছে একান্ত সাক্ষাৎকারে এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা বর্ণনা করেছেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিলাম পশ্চিমপাড়া গ্রামের বিশ্বযোদ্ধা শাহ নুর মোহাম্মদ। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রণাঙ্গনের সেসব দিনের কথাগুলো নতুন প্রজন্মকে জানাতে আজ থাকছে তার স্মৃতিচারণা।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিলাম পশ্চিম পাড়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর সেনানী শাহ নুর মোহাম্মদ। মৃত শাহ নাহার মোহাম্মদ ও অছিরা বিবির এই কৃতী সন্তান জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি।
যুদ্ধে যোগদান, প্রশিক্ষণ ও ফিরে আসা
শাহ নূর মোহাম্মদ ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ রয়েল সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে ভারতের পাঞ্জাবের ফিরোজপুর ট্রেনিং একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর ও হাবিলদার এবং পরে অনারারি ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে ট্রেনিং শেষে তাকে ইতালিতে বদলি করা হয়। সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। জার্মানরা সে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। পরে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে থাকেন।
যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সরকার তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ও ব্রিটেনে যাওয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু অসুস্থ মায়ের সেবা করার উদ্দেশ্যে সরকারের অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে আসার সময় ব্রিটিশ সরকার তাকে আত্মকর্মসংস্থানের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে সম্মাননা সনদ প্রদান করে বিদায়ী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তারপর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ ও দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের মাধ্যমে দেশে পাঠায়।

যুদ্ধের স্মৃতিচারণা
স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করে শাহ নূর মোহাম্মদ বলেন, আমি বেশ কিছু জায়গায় যুদ্ধে দায়িত্ব পালন করেছি। তার মধ্যে ইতালির ট্রান্ট, বারি, বারলেতা ও রোম; নেপালের আগ্নেয়গিরি, মিলান, তরিন টাউনে দায়িত্ব পালন করেছি।
পারমাণবিক গ্যাস ছাড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, মুখে রেস বোটার লাগাতে হয়। গ্যাস ছাড়ার মুহূর্তে অনেকের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এই কাজ আমি খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিলাম। সেখানে আমাকে সবাই 'বাঙালি বাবু' বলে ডাকত।
তিনি আরও বলেন, একবার আমরা এক পাহাড়ে গিয়ে অভিযানে বেশ কিছু ডিমের গাড়ি জব্দ করি। সে সময় ২০ বছরের এক তরুণী আমাদের ক্যাম্পে এসে কান্নাকাটি করলে দায়িত্বরত অফিসার আমার মাধ্যমে তাকে তার ডিমের ন্যায্যমূল্য প্রদান করেন।
কর্মস্থল
দেশে ফিরে আসার পর শাহ নূর মোহাম্মদ ভারতের আসামে সরকারি ট্রান্সপোর্টে সহকারী স্টোর কিপার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে দেওয়ার পর ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির কার্যক্রম আসাম থেকে শিলংয়ে স্থানান্তর করা হলে তিনি সেখানে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি সিলেট জেলা স্বাস্থ্য সহকারী এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
পরে সেটেলমেন্ট বিভাগের বেঞ্চ সহকারী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। এরপর সিলেটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রসেস সার্ভার হিসেবে যোগদানের পর তাকে বিশ্বনাথে সার্কেল অফিসের কার্যালয়ে বদলি করা হয়। সেখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর নেওয়ার পর তিনি সিলাম পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের মোতোয়ালি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।

বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা প্রাপ্তি
শাহ নূর মোহাম্মদ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈনিক হিসেবে ৩৯৪৫ স্টার ইতালি স্টার, ডিফেন্স মেডেল, ওয়ার মেডেল লাভ করেন। বর্তমানেও তিনি ব্রিটিশ আর্মির বিভিন্ন সেবা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বোর্ড সিলেটের সাবেক সচিব মেজর মোশারফ হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে জালালাবাদ সেনানিবাসের ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে তাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তা ছাড়া দক্ষিণ সুরমা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইউএনও মিন্টু চৌধুরী তার বাড়িতে এসে তাকে শুভেচ্ছা উপহার দেন। মুজিব বর্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক তিনি সংবর্ধনা লাভ করেন।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণা ও তার শেষ ইচ্ছা জানিয়ে শাহ নূর মোহাম্মদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখেছিলাম সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে। ‘শেখ সাব, শেখ সাব’ বলে স্লোগান দিয়েছিল সেদিন লোকজন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজয়ী সেনানী শাহ নুর মোহাম্মদ দাবি করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একবার হলেও সরাসরি দেখতে চাই। তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
এনএ