সংগ্রামী নাহারের এগিয়ে চলার গল্প

মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় ময়মনসিংহের ভালুকার জীবন নাহারকে (৩৫)। একদিকে স্বামী-সংসার, অন্যদিকে বইখাতা। দুটোকে একসঙ্গে আঁকড়ে ধরে প্রতি মুহূর্তে লড়তে হয়েছে তাকে। শেষ পর্যন্ত পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তিনি হয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এরই মধ্যে হারান স্বামীকে। মানসিক ধাক্কা খেলেও দমে যাননি তিনি। দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনের বাকি সময়ও লড়াই চালিয়ে যেতে চান অদম্য এই নারী।
জীবন নাহারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০১ সালে ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। ওই সময় তিনি দশম শ্রেণিতে পড়তেন। বিয়ের পরও নিজের ইচ্ছা শক্তির জোরে চালিয়ে যান পড়ালেখা। আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এমএ পাস করেন। ২০০৫ সালে তিনি বাটাজোর মনিচালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৮ সাল থেকে পদোন্নতি পেয়ে তিনি সেখানেই প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

২০১১ সালে ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হন স্বামী আসাদুজ্জামান। এরপর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে শুরু হয় তার নতুন সংগ্রাম। মাঝপথে একবার কিছুটা সুস্থ হলেও ২০১৫ সালে মারা যান তিনি। এরপর সংসারজীবনে মানসিকভাবে ধাক্কা খেলেও থেমে যাননি। সন্তানদের মানুষ করা আর স্কুলের দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করে যাচ্ছেন।
ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তিনি ভালুকা উপজেলা সদরে থাকেন। তার স্কুলটি ২৯ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত বাটাজোর মনিচালা এলাকায়। প্রতিদিন বিদ্যালয় পৌঁছাতে ও বাসায় ফিরতে তাকে পাড়ি দিতে হয় ৫৮ কিলোমিটার পথ। সন্তানদের কথা চিন্তা করে ও নিজের দায়িত্ব পালন করতে এত দূরের পথের ভোগান্তি হাসিমুখেই সয়ে যাচ্ছেন মানুষ গড়ার এই কারিগর। জীবন নাহারের দীর্ঘপথ চলার সঙ্গী এখন একটি স্কুটি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন আপন মহিমায়।

জীবন নাহার বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি বাটাজোর গ্রামে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য তাদের নিয়ে থাকতে হতো ভালুকা উপজেলা সদরে। দুই জায়গায় থাকতে গিয়ে চলাফেরায় অনেক জটিলতা দেখা দেয়। যাতায়াতে অনেক সময় নষ্ট হয়। বাসা থেকে স্কুলে আসতে প্রথমে রিকশা তারপর সিএনজি আবারও রিকশা নিতে হয়। বেশিরভাগ সময় স্কুলে যাওয়ার পথে যানবাহন পেলেও ফেরার পথে আর যানবাহন পেতাম না। এ নিয়ে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভালুকা সদর থেকে স্কুলে যাওয়ায় আমাকে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বের হতে হতো। সিএনজির জন্য প্রতিদিন এক থেকে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। আর রিকশা-সিএনজি মিলে যাতায়াতে খরচ হতো প্রতিদিন ২৭০ টাকা। তবুও মাঝেমধ্যে সময়মতো স্কুলে পৌঁছাতে পারতাম না। আমার খুব খারাপ লাগত। সবকিছু ভেবে আমি গত নভেম্বরে একটি স্কুটি কিনে ফেললাম। আগে চালাতে না পারলেও কেনার পর শিখে গেছি। এখন খুব দ্রুতই স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারি, আমার দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করতে পারি।

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সিঙ্গেল মাদার বা একক মায়েদের সন্তানকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। তারপরও নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে এককভাবে দুই সন্তানকে বড় করে তুলছেন অদম্য এই নারী। বড় মেয়ে তাহসীনা তাবাসসুম আনমনা দশম শ্রেণিতে পড়ে এবং ছেলে আরিয়ান জামান নার্সারির শিক্ষার্থী।
জীবন নাহার বলেন, চাকরির বাইরে পুরোটা সময় ছেলেমেয়েদের সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। স্কুটি কেনার পেছনে এটিও ছিল একটি কারণ। যেন বেঁচে যাওয়া সময়টুকু আমি ওদের দিতে পারি। আমি চেষ্টা করি বাবা-মায়ের দুইজনেরই আদর, ভালোবাসা সন্তানদের দিতে। সবসময় হয়তো হয়ে ওঠে না। যখন সন্তানরা অন্যের বাবাদের দেখে তখন তাদের খারাপ লাগে। বাবাকে মিস করে। তবুও প্রতিকূল পরিবেশে তাদের নিয়ে টিকে আছি। এতেই আলহামদুলিল্লাহ।
জীবন নাহার মনে করেন, নারীদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন শুধু যোগ্যতা আর মানসিক দৃঢ়তা। নারীদের এগিয়ে যেতে হলে সময়জ্ঞান রাখতে হবে। নারী হিসেবে বদ্ধ পরিবেশে না থেকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী হয়ে যদি দেশ পরিচালনা করতে পারেন তাহলে আমরা কেন থেমে থাকব। আমাদের এগিয়ে যেতে প্রয়োজন শুধু লক্ষ্য, সাহস, উদ্যম এবং দৃঢ় মনোবল।
কঠিন এই জীবন সংগ্রামে হার না মানা জীবন নাহারের সব সাহসী পদক্ষেপে গর্বিত তার সহকর্মীরাও। বাটাজোর মনিচালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এমদাদুল হক বলেন, সব বাধা পেরিয়ে তিনি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেভাবে পথ চলছেন তা নারীদের এগিয়ে যাওয়ারই একটি উদাহরণ। তার এমন জীবন সংগ্রাম ও এগিয়ে যাওয়ার গল্প অন্য নারীদের জন্যও অনুপ্রেরণার।
এসপি