৫ কিলোমিটারের ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাউন খালটি এখন সরু ড্রেন

পানি নিষ্কাশন আর নৌযান চলাচলের সুবিধার্থে ব্রিটিশ শাসনামলে খনন করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাউন খাল। এক সময় এই খালের পানিতে গোসল আর ধর্মজাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য ছিল নিত্যদিনের। ছোট-বড় অনেক নৌকাও চলাচল করত। কিন্তু সেসব এখন সোনালী অতীত। দখল আর দূষণে প্রায় ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঐতিহ্যবাহী টাউন খাল এখন সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। খালটি পুনঃখনন করে আবারও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি স্থানীয়দের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পানি নিষ্কাশন এবং নৌযান চলাচলের সুবিধার্থে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী তিতাস নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করে খনন করা হয় টাউন খাল। তবে খালটি ঠিক কনে সালে এবং কত টাকা ব্যয়ে খনন করা হয়েছিল- সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষের কাছে। শহরের জগতবাজার থেকে গোকর্ণঘাট পর্যন্ত খনন করা খালটির দৈর্ঘ্য ৪.৮০ কিলোমিটার। খালের প্রস্থ একেক জায়গায় একেক রকম। তবে এর গড় প্রস্থ ৯০ ফুট। খালটি দুই দিকেই তিতাস নদীতে গিয়ে মিশেছে।
আগে বর্ষা মৌসুম এলে পানিতে টইটম্বুর থাকত টাউন খাল। তখন নদীর মতো খালেও স্রোত থাকত। শহরের কাজীপাড়া এলাকার উঁচু ব্রিজ থেকে খালের পানিতে লাফিয়ে পড়ত দুরন্ত কিশোররা। পথচারীরা উঁচু ব্রিজে দাঁড়িয়ে শিশুদের দুরন্তপনা দেখে আনন্দিত হতো। স্থানীয় অনেকে খালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। এছাড়া এই খাল দিয়ে নৌকায় করে যাতায়াত করত বহু মানুষ। জগতবাজার নৌকাঘাট থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাত্রীবাহী ও পণ্যবোঝাই নৌকা চলাচল করত।
তবে এখন খালের সেই চিরচেনা রূপ আর নেই। গত ৭-৮ বছর ধরে খালের দুই পাড়ে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা এবং দূষণের ফলে খালটি সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে টাউন খাল। খালের পাড় ঘেঁষে করা হয়েছে বাসা-বাড়ি। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বাসা-বড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয় খালে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা আরিফুর রহমান জানান, শৈশবে বন্ধুদের সঙ্গে টাউন খালের পানিতে নিয়মিত গোসল করতেন তিনি। মাঝে মধ্যে বড়শি দিয়ে মাছও ধরতেন। শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় খালটি এখন প্রায় মৃত। শহরের বাসা-বাড়ি ও হোটেল-রেস্তোরাঁর ময়লা ফেলা হয় খালে। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউই নেই। খালটি পুনঃখনন করে আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।
মূলত খালের দুর্দশা শুরু হয় ২০০৮ সালের দিকে। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা কর্তৃপক্ষ খালটির সৌন্দর্যবর্ধনের নামে জগতবাজার থেকে শহরের কাজীপাড়া এলাকা পর্যন্ত খালের দুই পাড়ে সিসি ব্লক বসায়। এতে করে খালের প্রশস্ততা যেমন কমেছে, তেমনি তৈরি হয়েছে নাব্যতা সংকট। এছাড়া ব্লক বসানোর ফলে খালটি পুনঃখননেও এখন জটিলতা তৈরি হয়েছে।
অবশ্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ খালটি সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে খালে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারসহ কিছু জায়গায় খনন করা হয়। তবে কিছু দিন পর আবারও শুরু হয় দূষণ। ফলে খালটি ক্রমশ সরু ড্রেনে পরিণত হতে থাকে। এখন বর্ষাকালেও তেমন পানি আসে না খালে। যেটুক পানি আসে তাতে নৌযান চলার উপায় থাকে না। বিভিন্ন সংগঠন ও বিশিষ্টজনরা নানা সময় টাউন খালটি পুনঃখনন করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন।
নদী নিরাপত্তা বিষয়ক সংগঠন নেঙর এর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সভাপতি শামীম আহমেদ জানান, সিসি ব্লক বসিয়ে খালটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ব্লকের কারণে খালের প্রশস্ততা কমার পাশাপাশি নাব্যতা সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে বর্ষাকালেও খালে তেমন পানি থাকে না। ব্লকগুলো খুলে খালটি তিতাস নদীর গভীরতার সমান করে পুনঃখনন এবং খালের দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খালের সীমানা নির্ধারণের দাবি জানান তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র নায়ার কবির বলেন, ‘টাউন খালটি ব্রাহ্মণাবড়িয়ার ঐতিহ্যের একটি অংশ। পৌরসভার তৎকালীন মেয়র কীভাবে খালের দুই পাড়ে সিসি ব্লক বসিয়েছিলেন- সে বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে ব্লকের কারণেই খালের এই দূরাবস্থা। এখন খালের দুইপাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং কীভাবে পুনঃখনন করে আবার আগের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা চলছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সিসি ব্লক বসানোর পাশাপাশি খালের কিছু জায়গায় নিচ দিয়ে পাকা করে ফেলা হয়েছে। এতে করে খালটি পুনঃখনন করা জটিল কাজ। তবে খালটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমরা আন্তরিক আছি। এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের সঙ্গেও আমরা আলোচনা করছি।’
এসপি